প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারির গল্প

অধ্যাপক নবী আলম খান। ফাইল ফটো, অধ্যাপক এস আর খান। ছবি: লেখক
অধ্যাপক নবী আলম খান। ফাইল ফটো, অধ্যাপক এস আর খান। ছবি: লেখক

‘ওপেন হার্ট সার্জারি’ কথাটি কানে এলেই একটা ধাক্কা লাগে। কেউ বলেন, কী এমন হলো যে বুক চিরে চিকিৎসা করা লাগবে? চিকিৎসকদের প্রসঙ্গে অনেকে সবিস্ময়ে ভাবেন: ‘হৃৎপিণ্ডে ছুরি চালায়, এরা মানুষ না দেবতা?’

বাংলাদেশে হৃদ্‌রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপেন হার্ট সার্জারি বাড়ছে। এই চিকিৎসা পাওয়া যায় এমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের শল্যচিকিৎসকসহ অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীর সংখ্যাও বেড়েছে। বছরে ৫ হাজারের বেশি মানুষ এই চিকিৎসার সুযোগ দেশেই পাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার ১০ বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে দেশে প্রথম যখন এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এ দেশের চিকিৎসকেরা এ দেশের মানুষকে সুস্থ করে তুলছিলেন, তখন বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’ বিষয়টি ছিল একেবারে নতুন। পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটিতে আধুনিক এই চিকিৎসা-প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ চিকিৎসকদের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দেয়। দেশ তার সুফল পাচ্ছে।

শুরুর একটা গল্পটা থাকে। ইতিহাস ধরে রাখার উদ্যোগ ছিল না বলে বাংলাদেশে ওপেন হার্ট সার্জারির শুরুর গল্পটা হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে অধ্যাপক এস আর খান আজও ঘটনার অনেক কিছুই মনে করতে পারেন। গত ২৫ ডিসেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধ্যাপক নবী আলম খান আর আমি এই অস্ত্রোপচার করেছিলাম। অধ্যাপক নবী মারা গেছেন সম্ভবত ২০০৭ সালে। আর রোগীর বিস্তারিত এখন বলা মুশকিল।’

বুকে কান পাতলে ধুকধুক শব্দ শোনা যায়। এই শব্দ হৃৎপিণ্ডে রক্ত ঢোকা ও বের হওয়ার। হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় শল্যবিদেরা হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি থামিয়ে অস্ত্রোপচার করেন। তখন রক্ত সঞ্চালনের কাজটি হয় কৃত্রিম উপায়ে। এই চিকিৎসা-প্রযুক্তির নাম ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কার্ডিওপালমোনারি বাইপাস (সিপিবি)। এই পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করার সময় হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ করে একটি যন্ত্র। এই যন্ত্রের নাম ‘হার্ট-লাং মেশিন’। হৃৎপিণ্ডের কাজটিকে যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দেওয়াই হচ্ছে ওপেন হার্ট। বুক চিরে বা খুলে হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার হয় বলেই এর নাম ওপেন হার্ট সার্জারি নয়।

ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে এস আর খান ইংল্যান্ডে যান চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রি ও দক্ষতা অর্জনের জন্য। বয়সে কিছুটা বড় ছিলেন অধ্যাপক নবী আলম খান। তিনিও তখন ইংল্যান্ডে ছিলেন। দুজনেই হৃদ্‌রোগ ও হৃদ্‌রোগের শল্যচিকিৎসার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নেন। এস আর খান বলেন, ‘১২ বছর আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করি। মন দিয়ে কাজটি শিখি। হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার এই বিশেষায়িত দিকটির ব্যাপারে আমার প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল, এখনো আছে।’

১৯৭৮ সালে পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে ১১টি দেশের ওপর দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে ১৯ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২২টি সীমান্ত অতিক্রম করে ২৮ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন এই বরেণ্য চিকিৎসক। দেশে ফিরে যোগ দেন সরকারের বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে। এক বছর পর অধ্যাপক নবী আলম খান দেশে ফিরে তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) যোগ দেন।

এস আর খান বলেন, টিমওয়ার্ক ছাড়া ওপেন হার্ট সার্জারি করা সম্ভব নয়। দলের প্রতিটি সদস্য হবেন সাহসী, যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ। এই দলে থাকেন কার্ডিয়াক সার্জন, অবেদনবিদ, কার্ডিয়াক সার্জনদের সহকারী, যন্ত্রবিদ (সার্জিক্যাল টেকনোলজিস্ট), নার্স ও পারফিউসনিস্ট। হার্ট-লাং যন্ত্র পরিচালনা করেন পারফিউসানিস্ট।

নবী আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। ইনস্টিটিউটটি এখন একেবারে আলাদা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। নতুন নাম জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি)। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল বা এনআইসিভিডি কারও কাছে দেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারির বিস্তারিত তথ্য নেই। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে পাওয়া যায়নি।

তবে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারিতে কার্ডিয়াক সার্জনদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন অধ্যাপক নাসির উদ্দীন আহমেদ। কার্ডিয়াক সার্জারিতে তিনি দেশের প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী চিকিৎসক। এনআইসিভিডি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে বেসরকারি আয়েশা মেমোরিয়াল কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে কাজ করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারির রোগীর নাম ছিল মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। ১৯৮১ সালে মোস্তাফিজুর রহমান সাতকানিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। তাঁর হৃৎপিণ্ডের ছিদ্র ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছিল।

নাসির উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রথম অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত হার্ট-লাং যন্ত্রটি জাপান সরকারের সহায়তায় আনা হয়েছিল। আর পারফিউসনিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন একজন জাপানি নাগরিক। নার্সদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত সফল ছিল দেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি।’

 ‘ওপেন হার্ট সার্জারির শুরুটা ভালো হওয়ায় এই বিশেষায়িত চিকিৎসা দেশে বেশ ভালোভাবেই প্রসার লাভ করেছে’—এমনই মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী। তিনি বলেন, হৃৎপিণ্ড থামিয়ে প্রথম অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এখন হৃৎপিণ্ড সচল অবস্থায় অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনিসহ আরও অনেকে সচল হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার করছেন।

হৃৎপিণ্ডে কেন অস্ত্রোপচারের দরকার হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটের হৃদ্‌রোগ শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক রমাপদ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, অনেকের হৃৎপিণ্ডে জন্মগত ত্রুটি থাকে। ওষুধে সেই ত্রুটি দূর করা সম্ভব হয় না। শল্যচিকিৎসাই একমাত্র বিকল্প। অনেকের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়। রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প পথ তৈরিতে ‘বাইপাস সার্জারি’ করতে হয়। এটাও ওপেন হার্ট সার্জারি। আরও কিছু জটিলতায় ওপেন হার্ট সার্জারি একমাত্র ভরসা।

এ দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সফল ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। রমাপদ সরকার বলেন, জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে ২০১৫ সালে ১ হাজার ৬১টি, ২০১৬ সালে ৯৯৬টি এবং ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১৪টি ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ২২টি হাসপাতালে বর্তমানে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত শল্যচিকিৎসক আছেন প্রায় ১০০ জন। ওপেন হার্ট সার্জারি করতে এখন কম মানুষই দেশের বাইরে যান।

অধ্যাপক এস আর খান বলেন, ‘আমরা যখন এই বিশেষায়িত চিকিৎসা শুরু করেছিলাম, তখন অর্থ একটি বড় বাধা ছিল। যন্ত্রপাতি কেনার, প্রশিক্ষণ নেওয়ার অর্থের অভাব ছিল। অন্যদিকে রোগীদেরও আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি নেই।’

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা দাবি করছেন, হৃদ্‌রোগের সব ধরনের চিকিৎসা এখন দেশে আছে। বিশ্বের আধুনিক প্রায় সব প্রযুক্তিই এ দেশের চিকিৎসকেরা ব্যবহার করছেন। এখন অপেক্ষা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের। এক ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড অন্যের শরীরে জুড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন হৃদ্‌রোগ শল্যচিকিৎসকেরা। হৃৎপিণ্ড দেওয়ার জন্য দেশের মানুষের প্রস্তুতি দরকার।