নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রস্তুত

বিএনপি পতাকা
বিএনপি পতাকা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত বিএনপি। এরই মধ্যে দলীয় প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরি ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সাংগঠনিক প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে দলটি। তবে নির্বাচনের মাঠ সবার জন্য সমান থাকবে কি না, তা নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকদের শঙ্কা রয়েছে।

দলটির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঠে সমান সুযোগ পেলে ক্ষমতাসীনেরা যত কৌশলই নিক, খেলার জন্য প্রস্তুত আছে বিএনপি।’

বিএনপির সূত্র জানায়, শক্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে দলীয় বাছাইয়ের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে ৭৭টি সাংগঠনিক দল মাঠপর্যায়ে সফর ও কর্মিসভা করেছে।

এই সফরে মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এক. আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি। দুই. স্থানীয়ভাবে বিবাদ মিটিয়ে নেতাদের মিলমিশ করিয়ে দেওয়া। তিন. প্রয়োজনে আন্দোলনে নামার জন্য দলকে প্রস্তুত করা। এ ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারাধীন দুটি দুর্নীতির মামলার রায়-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ গত শনিবার রংপুরে কর্মিসভা করে ঢাকায় ফেরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচন-আন্দোলন দুটোরই প্রস্তুতি নিচ্ছি। নেতা-কর্মীরাও কাজ শুরু করেছে। স্থানীয়ভাবে জনগণ থেকেও প্রচুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’

মাঠপর্যায়ে সফরকারী একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার নানা লোভ ও টোপ দিয়ে বিএনপিতে বিভেদ তৈরি করতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে নেতা-কর্মীদের যেকোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এই মুহূর্তে বিএনপির দুশ্চিন্তার একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে করা দুটি মামলার বিচারকাজ। এ কারণে দলের অনেক কর্মসূচিতে নেতারা মনোযোগ দিতে পারছেন না। আগে সিদ্ধান্ত ছিল, ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে মহানগর ও জেলা পর্যায়ে বড় জনসভা করার। খালেদা জিয়ার মামলার বিচারকাজের কারণে তা পিছিয়ে গেছে। এ মামলার বিচারকাজ যে গতিতে এগোচ্ছে, এটাকে বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র মনে করছেন দলটির নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন শুনছি বেগম খালেদা জিয়ার আরও কয়েকটি মামলা বিশেষ আদালতে স্থানান্তর করেছে। এগুলো সরকারের দুরভিসন্ধি।’ তিনি বলেন, বিএনপিকে আদালতের বারান্দায় রেখে আবার একতরফা নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের জন্য শুভ হবে না।

সহায়ক সরকারের রূপরেখা ও ইশতেহারের প্রস্তুতি
বিএনপি একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে আসছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সহায়ক সরকারের একটি রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। নেতারা বলছেন, উপযুক্ত সময়ে এই রূপরেখা ঘোষণা করা হবে। সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রস্তুত করার পাশাপাশি একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির কাজও শুরু করা হয়েছে। দলের শুভাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এর সঙ্গে যুক্ত আছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ শিরোনামে যে খসড়া পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন, সেটির অবলম্বনে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করা হচ্ছে।

দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, জরিপ ও গবেষণার কাজে পেশাদার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েও বিএনপি সারা দেশে মাঠপর্যায়ে ভোটারদের মনোভাব জানার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই দলের সম্ভাব্য জনপ্রিয় প্রার্থীর পাশাপাশি ভোটারদের চাহিদা জানা, তাঁরা কেমন প্রার্থী চান, নির্বাচনী ইশতেহারে কী কী আসা উচিত ইত্যাদি প্রশ্ন থাকছে বলে জানা গেছে।

৫১ জেলার কমিটি গঠন
কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েও মাঠপর্যায়ে বিএনপির কমিটি গঠনের কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি। ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৫১টির আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা গেছে। আরও পাঁচ-ছয়টি জেলার কমিটি গুছিয়ে আনা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে ঘোষণা করা হতে পারে। ছাত্রদল, কৃষক দলসহ কয়েকটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে মহিলা দল, যুবদল ও মুক্তিযোদ্ধা দলের কমিটি হয়েছে। সব অঙ্গসংগঠনকে দ্রুত মাঠপর্যায়ে কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রার্থী বাছাই
দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ প্রাথমিকভাবে শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১২৫টির মতো আসনে প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত, যাঁদের রদবদলের সম্ভাবনা কম। এই তালিকায় দলের শীর্ষস্থানীয় ও জ্যেষ্ঠ নেতারা আছেন। এর বাইরে আরও শতাধিক আসনেও প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই হয়েছে। তবে সেটা চূড়ান্ত নয়। তাঁদের যোগ্যতা ও স্থানীয় জনপ্রিয়তা যাচাই করা হবে। ২০-দলীয় জোটের শরিকদের পাশাপাশি জোটের কিছু আসন ফাঁকা রাখা হবে। আবার জোটের বাইরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে যদি সমঝোতা হয়, তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় করারও চিন্তা আছে।

জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে বিএনপি আরও উদার রাজনীতির পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারবিরোধী নির্বাচনী পাল্লা ভারী করতে এবার প্রয়োজন হলে ২০-দলীয় জোটের বাইরের দলকেও ছাড় দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, তাঁরা মনে করছেন, সরকার বিএনপিকে আবারও নির্বাচনের বাইরে রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা করবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিকে আরও চাপে রাখতে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করবে।

মাঠপর্যায়ে কমিটি গঠনের দায়িত্বে থাকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ভয় এক জায়গায়, সমতল মাঠ পাব কি না। দরকার পরিবেশ। নির্বাচনের তফসিলের পর কেউ যেন এককভাবে মাঠ দখলে নিতে না পারে, সে পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানোর জন্যও আগামী সংসদ নির্বাচন জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখনই মাঠ দখল করে আছে। নির্বাচনের মাঠ দখলে রাখার অভিপ্রায় থেকেই সংবিধান সংশোধন করে মেয়াদপূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিধান করেছে। অর্থাৎ এক সংসদ বহাল রেখে আরেক সংসদ নির্বাচন—যা কোথাও নেই।

অবশ্য প্রায় এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির জন্য আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা না-থাকার লড়াই হিসেবে দেখা হচ্ছে।