হাজীগঞ্জ দুর্গ চেনা দায়

হাজীগঞ্জ দুর্গের আশপাশ ঝোপঝাড় ও আবর্জনায় ভরে গেছে। দুর্গের বেশ কিছু অংশ ভাঙা। সম্প্রতি হাসান রাজার ক্যামেরায় l প্রথম আলো
হাজীগঞ্জ দুর্গের আশপাশ ঝোপঝাড় ও আবর্জনায় ভরে গেছে। দুর্গের বেশ কিছু অংশ ভাঙা। সম্প্রতি হাসান রাজার ক্যামেরায় l প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জ শহরে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ দুর্গ। দর্শনীয় এই স্থাপনার আশপাশের জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণও ঠিকমতো হচ্ছে না। দর্শনার্থীরা ঘুরতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, দুর্গ ঘেঁষে বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। দখলের কারণে মূল সড়ক থেকে দুর্গটি ঠিকমতো দেখা যায় না। দুর্গের বেশ কিছু অংশ ভাঙা। বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা, সিগারেটের প্যাকেট, কাচের বোতল। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় সরকারি তোলারাম কলেজেরশিক্ষার্থী নাসিমা কলির সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি, হাজীগঞ্জ নামে একটি সুন্দর জায়গা আছে। এসে হতাশ হয়েছি। এটা আসলে কী, বোঝা যাচ্ছে না। এটার কোনো ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। দুর্গের রাস্তা খুব খারাপ।’ আরেক শিক্ষার্থী শাবনূর আক্তার বলেন, ‘এখানে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। দেখভালের লোক নেই। অপরিষ্কার, অনেক জায়গা ভেঙে গেছে।’

দুর্গের দায়িত্বে রয়েছেন দৈনিক চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক মো. রায়হান। তিনি দাবি করেন, তিনি নিয়মিত দুর্গ পরিষ্কার ও দর্শনার্থীদের সহায়তা করেন। তবে লোকস্বল্পতার কারণে ঠিকভাবে পারেন না। আগে তিনজন ছিলেন, দুজন চলে গেছেন। এ কারণে সমস্যা হচ্ছে।

নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কেউ রায়হানকে তদারক করেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপস্থিতি জানতে কেউ তাঁকে ফোন করেন না। তবে অন্য কোনো দরকার হলে ফোন করেন।  

দুর্গ তদারকের বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় বলেন, ‘আমরা একটু দূরে থাকি। আমরা গেলে হয়তো পরিষ্কার করে। অন্য সময় করে না। হয়তো সেভাবে নিজের মনে করে না। ফোনে মনিটরিং (খোঁজখবর) করি। ঢাকা বিভাগে ১১৫টি সাইট (প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা) আছে। নিয়মিত মনিটরিং করা সম্ভব হয় না। জায়গাগুলো নিজেদের আওতায় নিয়ে আসা যায়নি। তাই আশপাশ দখল হয়ে গেছে।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা হাজীগঞ্জ দুর্গের পাশ দিয়ে একসময় শীতলক্ষ্যা নদী প্রবাহিত হতো। বর্তমানে নদী দুর্গ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। দুর্গ নির্মাণের সঠিক তারিখ  এবং এর নির্মাতা কে ছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে দুর্গটি মোগল আমলে সপ্তদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে জানা গেছে। আরাকানি (মগ) জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেই এই দুর্গ নির্মিত হয়েছিল। অসমান বাহু ও ছয়কোনাবিশিষ্ট দুর্গের উত্তরে রয়েছে তোরণযুক্ত প্রধান প্রবেশপথ। প্রবেশপথের সিঁড়িতে ১৯টি ধাপ আছে। দুর্গের ছয়কোনায় নির্মিত বুরুজগুলো সম-আকৃতির নয়। তুলনামূলক দক্ষিণের বুরুজ দুটি বড়।

হাজীগঞ্জ দুর্গ ঘেঁষে বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে l প্রথম আলো
হাজীগঞ্জ দুর্গ ঘেঁষে বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে l প্রথম আলো

প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মধ্যভাগে কোনো স্থাপনা নেই। দুর্গের অভ্যন্তরে পূর্ব দিকে বর্গাকার উঁচু একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে। প্রাচীরের উপরিভাগ মোগল আমলের অন্যান্য দুর্গের মতো মারলন আকৃতির। দুর্গের জমির পরিমাণ ১৯ দশমিক ৬৪ একর। ১৯৫০ সালের ১৬ নভেম্বর এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা হয়।    

তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুর্গের চারপাশকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে এবং চারপাশের পরিবেশের সামগ্রিক উন্নয়নকল্পে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটির সীমানা ও রাস্তার দুরবস্থার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনকে জানানো হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মইনুল হক বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে ছয়-সাত মাস আগে জমির মালিকানা, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, দুর্গটিকে দর্শনার্থীদের জন্য প্রস্তুত করা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তাদের নীতিমালা অনুযায়ী, আমরা দেখভালের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আর কোনো সাড়া পাইনি। দুর্গটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে দায়িত্ব দেওয়ার কোনো চিঠিও পাইনি।’

মইনুল হক বলেন, হাজীগঞ্জ দুর্গের চারপাশ ঘিরে ২১টি পোশাক কারখানা অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। অধিদপ্তর থেকে পরবর্তী ব্যবস্থা না নেওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আটকে আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাখী রায় বলেন, ‘গত অর্থবছরে ভাঙাচোরা অংশ মেরামতের জন্য কোনো বরাদ্দ ছিল না। আমরা সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর ও প্রকৌশলীর সঙ্গে বসেছিলাম। দুর্গের আশপাশের রাস্তা মেরামতসহ বিভিন্ন কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। চিঠি দেওয়া তো মূল বিষয় না। তারপরও যদি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি চায়, আমরা দিয়ে দেব।’