জেব্রা ক্রসিং না পদচারী-সেতু?

সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা
সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা

আধুনিক শহরগুলোতে রাস্তা পারাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় জেব্রা ক্রসিং। পথচারী পারাপারের জন্য ব্যস্ত রাস্তায় সাদা-কালো ডোরাচিহ্নিত নির্দিষ্ট অংশ জেব্রা ক্রসিং নামে পরিচিত। আবার পারাপারের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পদচারী-সেতুও ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু ঢাকার মতো জনবহুল নগরের জন্য কোনটি বেশি প্রযোজ্য? জেব্রা ক্রসিং নাকি ব্যয়বহুল পদচারী-সেতু? ঢাকার পদচারী-সেতুগুলো নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী নয়। এগুলো যথাযথ স্থানেও তৈরি হয়নি। ফলে নাগরিকদের মধ্যে পদচারী-সেতু ব্যবহারে অনীহা দেখা যায়। এই অবস্থায় পদচারী-সেতু ব্যবহার না করলে জরিমানাও করা হচ্ছে মানুষকে। এই পরিস্থিতি জেব্রা ক্রসিং নাকি পদচারী-সেতু—এই বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক পথচারীদের জরিমানার বিষয়ে বলেন, ‘যারা পদচারী-সেতু ব্যবহার না করায় জরিমানা করেছে, তাদেরই জরিমানা করা উচিত। কারণ, পদচারী-সেতু বানিয়ে পথচারীদের চলাচলের সমাধান করার উদ্যোগ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ছিল। এখন সভ্যতা এগিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান এগিয়েছে। তখনকার যুগে গাড়িকে অগ্রাধিকার দিয়ে পথচারীকে আলাদা করা হতো। সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে চিন্তাই করা হয়নি। যারা সবল, তাদের কথাই ভাবা হয়েছিল তখন। কিন্তু মানুষ এখন জেনেছে, যত কষ্ট করে পদচারী-সেতু বানানো হোক না কেন, ভিড়ের সময় কখনোই পদচারী-সেতু মানুষ ব্যবহার করতে চায় না। এটাই স্বাভাবিক। আর এটা স্বাভাবিক বলেই ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে, হচ্ছে।’

সরেজমিনে ঘুরে পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে সেই জানা তথ্যই আবার জানা গেল। পদচারী-সেতুগুলো অসুস্থ নারী-পুরুষ, প্রতিবন্ধী, শিশু ও বৃদ্ধ কিংবা ভারী ব্যাগ বহনকারীদের জন্য উপযোগী নয়। পদচারী-সেতুর উচ্চতা, এর নোংরা পরিবেশ, হকার ও মাদকসেবীদের দখল করে রাখা—সবকিছু মিলে এই সেতু পথচারীদের জন্য অনিরাপদ। মানুষ নিরাপদে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সড়ক পার হতে চায়।

কিন্তু ঢাকার রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং আছে হাতে গোনা। এর বেশির ভাগের আবার সাদা চিহ্ন মুছে গেছে।

পদচারী–সেতু ব্যবহার করেন না পথচারীরা
পদচারী–সেতু ব্যবহার করেন না পথচারীরা

শনির আখড়ায় বসবাসকারী এক চাকরিজীবী নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দনিয়া কলেজের সামনে একটি ফুটওভারব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। নিচ দিয়ে রাস্তা পার হওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফুটওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পার হওয়ার আর কোনো উপায়ও নেই। আমার মা স্ট্রোক করা রোগী। তাঁকে একদিন বারডেমে নিয়ে যেতে ওটা পার হয়েছি। কী যে কষ্ট হয়েছে, তা বলার মতো নয়। এই অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝলাম, ছোট বাচ্চা ও ডিজঅ্যাবলদের জন্য এটা কত কষ্টের।’

ঢাকায় পদচারী-সেতুর সংখ্যা ৮৯। এর অনেকটিই ব্যবহৃত হয় না। আন্ডারপাস (পাতালপথ) আছে তিনটি। এর মধ্যে রাস্তা পারাপারে ব্যবহৃত হয় দুটি। দুটি পদচারী-সেতুতে চলন্ত সিঁড়ি লাগানো হয়েছে। এর একটি নষ্ট। রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সংযুক্ত করতে একটি র‍্যাম্প করা হয়েছে। সেটা কেউ ব্যবহার করে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ডিএসসিসিতে পদচারী-সেতু ৩১টি, প্রতিবন্ধীদের জন্য আরও নতুন ৬টি তৈরি করার পরিকল্পনা আছে।

ঢাকায় আর পদচারী-সেতু বানানোর বিপক্ষে পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘পদচারী-সেতুগুলো সবার জন্য নয়। এখনকার দিনে প্রকৌশলগত সমাধান হলো, মানুষ যেভাবে পার হতে চায়, সেভাবেই তাকে পার হতে দাও। সেটা নিরাপদে কীভাবে করতে হবে তার ব্যবস্থা করো। পুরো বিশ্বে এখন এই পদ্ধতিই সর্বজনস্বীকৃত, নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য। কারণ, মোড়গুলো পথচারী ও গাড়ি উভয়ের জন্য। দুই পক্ষকে সহাবস্থানে রাখার জন্য দরকার কার্যকর ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা। গাড়ি যখন থামবে, পথচারী তখন পার হবে। তিনি বলেন, উন্নত দেশে পদচারী-সেতু সব সময় নিরুৎসাহিত করা হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘মানুষের পারাপারের ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। জোর করে পদচারী-সেতু ব্যবহার করানো কখনোই কাম্য নয়।’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রিফাত পাশা প্রতিদিন মগবাজার থেকে ধানমন্ডিতে যান। বাংলামোটরে এসে তাঁকে আবার রিকশা বদলাতে হয়। রিফাত পাশা বলেন, ‘বাংলামোটরের মোড়ের ফুটওভারব্রিজে অনেক দিন চেষ্টা করেছি ওঠার জন্য। পারিনি। আমার পক্ষে একটি ছড়ি নিয়ে ওই ফুটওভারব্রিজে তড়িঘড়ি করে ওঠা প্রায় অসম্ভব। দুই-আড়াই বছর ধরে কষ্ট করে রাস্তা দিয়েই হেঁটে পার হচ্ছি। পরিচিত হয়ে যাওয়ায় মানুষ, ট্রাফিক পুলিশ সহায়তা করে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৮টি পদচারী-সেতু আছে। আরও ২টি তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আরিফুর রহমান জানালেন, সিটি করপোরেশনের বাজেট কম থাকায় এগুলোতে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

পদচারী-সেতুর চেয়ে জেব্রা ক্রসিং তৈরিতে খরচ কম, পথচারীরাও এ পথই ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু আরিফুর রহমানের ভাবনা ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষ আইন মানে না; যত্রতত্র রাস্তা পার হয়। এখন যদি মূল সড়কে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকবে। যানজট আরও বাড়বে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলামের ভাবনাও প্রায় একই রকম। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পারাপারে মানুষ বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের পদচারী-সেতু ব্যবহারের মানসিকতা তৈরি করতে হবে।’

তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সড়ক পারাপারে সিটি করপোরেশন জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার বাড়াতে পারে। ট্রাফিক বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে।