পরিবার ভয়ে, 'বন্ধু'র মামলা নিয়ে প্রশ্ন

তানিম খান
তানিম খান

সিলেটে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগের কর্মী তানিম খান (২২) হত্যার ঘটনায় তাঁর পরিবার ভয়ে মামলা পর্যন্ত করেনি। পুলিশের পক্ষ থেকেও মামলা হয়নি। মামলা করেছেন তাঁর এক কথিত বন্ধু ছাত্রলীগের আরেক কর্মী দেলোয়ার হোসেন। হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর (১০ জানুয়ারি মধ্যরাত) মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় মামলাটি করা হয়।

গতকাল শুক্রবার রাতে তানিমের বাবা ইসরাইল খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি ভয়ে মামলা করেননি। কিসের ভয়, কারা ভয় দেখাল? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ২০ বছর আমার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছি। আমার পরিবার আওয়ামী লীগের পরিবার। কিন্তু আমি ভরসা পাচ্ছি না। ভয়ে আছি। যে ছুরি ছেলের গলায় চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই ছুরি এখন আমার কলিজায় বিদ্ধ হয়ে আছে। মামলা করে বিচার পাওয়ার কোনো ভরসা পাইছি না। এ কারণে মামলা করিনি। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গ্রামের মানুষ। গ্রামে থাকি। শহরের পলিটিকসের লগে পাল্লা দিতাম পারতাম না।’

শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন বলেছেন, পরিবার মামলা করতে রাজি হয়নি। তানিমের বন্ধু বাদী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এভাবে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজের তিনজন নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী মহলের প্রভাবে পরিবারের সদস্যরা কেউ মামলা করার সাহস পাননি।

এদিকে ছাত্রলীগের কর্মী দেলোয়ারের করা মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে চারজনকে আটক করেছিল, তাঁদের তিনজনকেই এ মামলায় আসামি করা হয়নি। এ মামলার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, জানতে চাইলে বাদী দেলোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও ভয়ের মধ্যে আছি। আমি তানিমের বন্ধু। আমার ওপরও আক্রমণ হতে পারত।’

পুলিশ সূত্র জানায়, তানিম হত্যা মামলায় ২৯ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান আসামি করা হয়েছে নগর আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদুর রহমানের ভাতিজা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে আজলাকে। বাকি ২৮ আসামিদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের পরপরই সন্দেহভাজন হিসেবে আটক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন ওরফে ডায়মন্ডও আছেন। ২৯ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

 টিলাগড়কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব

সিলেট নগরের তামাবিল মহাসড়কের একটি মোড়ের নাম টিলাগড়। এক পাশে এমসি কলেজ, সরকারি কলেজসহ আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের দুটো পক্ষ সক্রিয়। গত তিন মাসের ব্যবধানে ছাত্রলীগের টিলাগড়কেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তিনটি। এর মধ্যে গত ১৬ অক্টোবর টিলাগড়ে ছাত্রলীগের কর্মী ওমর মিয়াদ হত্যায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী অভিযুক্ত হওয়ায় ১৮ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। কমিটি বিলোপের পর দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি তৎপরতা চলছিল।

৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে টিলাগড়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের জের ধরে ৭ জানুয়ারি রাতে অতর্কিত হামলায় খুন হন তানিম খান। সিলেট সরকারি কলেজের স্নাতক (পাস) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তানিমের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গা গ্রামে। ঘটনার পরপরই হত্যার জন্য টিলাগড় এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা আজাদুর রহমানের অনুসারী ছাত্রলীগের একটি পক্ষ এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল।

তানিমকে প্রধান আসামি সিদ্দিকুর রহমান ওরফে আজলা ছুরিকাঘাত করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে পূর্ব দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। আজলার সঙ্গে ২৮ জন ও অজ্ঞাত আরও ৫ জন ছিলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

তানিম বুরুঙ্গা গ্রামের ইসরাইল খানের ছেলে। টিলাগড়ের পার্শ্ববর্তী মেজরটিলা এলাকায় একটি মেসবাড়িতে থাকতেন। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সপ্তম ছিলেন তানিম। বাবা ইসরাইল খান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একটানা ২০ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বড় ভাই বাবলু খান ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের পরিবারের সন্তান দলীয় কোন্দলে নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিবারসহ এলাকাবাসীও মুষড়ে পড়েন। পরিবার থেকে এ ঘটনায় মামলা না করায় বিস্মিত এলাকাবাসীসহ তানিমের রাজনৈতিক সহপাঠীরাও।

 তিন দিনের কর্মসূচি শেষ হলো

তানিম হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে সিলেটের এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের টানা তিন দিনের কর্মসূচি গতকাল শুক্রবার শেষ হয়েছে। গতকাল আসরের নামাজ শেষে হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ জামে মসজিদে দোয়া মাহফিলের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শেষ হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার মামলার প্রধান আসামি আজলাসহ সব আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবিতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধনে এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগের কর্মী ও জেলার বিলুপ্ত কমিটির নেতারা অংশ নেন। মানববন্ধন চলাকালে জেলার বিলুপ্ত কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় চৌধুরী, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, দেলোয়ার হোসেন, নাজমুল ইসলাম, হোসাইন আহমদ চৌধুরী, কনক পাল, মওদুদ আহমদ, সৌরভ দাস প্রমুখ বক্তব্য দেন।

বিলুপ্ত জেলা ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় চৌধুরী জানিয়েছেন, টানা তিন দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন শেষে আসামিদের গ্রেপ্তারে সময় বেঁধে দিয়ে আজ শনিবার পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে।