বাঘ পালানো মাঘের শীত

কনকনে শীতে কাঁপছে দেশ। শীত থেকে রক্ষা করতে শিশুকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছেন মা। বাসাইল, শিবালয়, মানিকগঞ্জ, ১৪ জানুয়ারি। ছবি: আব্দুল মোমিন
কনকনে শীতে কাঁপছে দেশ। শীত থেকে রক্ষা করতে শিশুকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছেন মা। বাসাইল, শিবালয়, মানিকগঞ্জ, ১৪ জানুয়ারি। ছবি: আব্দুল মোমিন

‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’ প্রবাদের মর্মার্থ এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। গতকাল রোববার মাঘের শুরু হলেও এবার সেই মাঘের শীত শুরু হয়েছে পৌষের ২০ তারিখ, অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি। ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও বিরতি দিচ্ছে না কনকনে শীত। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় টানা শৈত্যপ্রবাহকে ব্যতিক্রম বলছেন আবহাওয়াবিদেরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শৈত্যপ্রবাহ আরও দু-তিন দিন চলতে পারে। এরপর ক্রমে তা দুর্বল হয়ে আসতে পারে। গত তিন দিনে দেশের বেশির ভাগ এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।

তবে শীতের কষ্ট কমেনি, বরং কুয়াশা ঘন হয়ে সড়কে-নৌপথে দৃষ্টির সীমা কমিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে শীতল হু হু বাতাস বাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের ভোগান্তি, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ বেশ বিপদে পড়েছে।

সাধারণত তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে সেই পরিস্থিতিকে শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১০ দিনের বেশি টানা শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে ১৯৮৯, ২০০১, ২০০৩, ২০১১ ও ২০১৩ সালে। কিন্তু ওই শৈত্যপ্রবাহগুলো মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোর ও চুয়াডাঙ্গা এবং উত্তরাঞ্চলের জেলা দিনাজপুরে সক্রিয় ছিল। কিন্তু চলমান শৈত্যপ্রবাহটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর-চুয়াডাঙ্গা, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর-কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়, মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ, পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলায় একযোগে সক্রিয় ছিল। ৮ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বাংলাদেশে রেকর্ড।

৩০ বছরের বেশি সময় আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) বিশেষ গবেষণা ফেলো সমরেন্দ্র কর্মকার। দেশে তাপমাত্রা ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও শীত কেন কমছে না, সেই প্রশ্নের জবাবে এই গবেষক প্রথম আলোকে বলেন, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বিশাল ও ঘন জলীয় বাষ্পের প্রবাহ ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। আর উত্তরাঞ্চল দিয়ে জেট বায়ু সক্রিয় আছে। এই দুটি মিলে বাংলাদেশের তাপমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে এই টানা শৈত্যপ্রবাহ চলছে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি) থেকে চলতি সপ্তাহে পূর্ব ভারতের জন্য দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পূর্ব ভারত, অর্থাৎ বিহার, পশ্চিমবঙ্গসহ আশপাশের এলাকায় যে কুয়াশার স্তরটি রয়েছে, তা আরও তিন-চার দিন থাকতে পারে। তবে তা পর্যায়ক্রমে ফিকে বা হালকা হয়ে আসতে পারে। এতে দু-তিন দিনের মধ্যে ওই এলাকায় শৈত্যপ্রবাহের দাপট কমে যেতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে ৩ জানুয়ারি শৈত্যপ্রবাহটি মৃদু আকারে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুরু হয়। ৫ জানুয়ারি তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ৭ জানুয়ারি থেকে আবারও তাপমাত্রা কমতে থাকে। ৯ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা আবারও বাড়ছে। কিন্তু দেশের দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ২২টি স্থানের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল। বাকি ২১টি এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ থেকে ১৪ ডিগ্রির মধ্যে থাকলেও সেখানে ঘন কুয়াশা ও দমকা শীতল হাওয়া ছিল। ফলে শীতের অনুভূতি রয়ে গেছে। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যশোরে-৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু গবেষক আবদুল মান্নান বলেন, ‘এবার টানা ১১ দিন যে শৈত্যপ্রবাহটি চলছে, তা একটু অস্বাভাবিক। কেননা, এর আগের শৈত্যপ্রবাহগুলোর অঞ্চলভিত্তিক সক্রিয়তা আমরা লক্ষ করেছি। যেমন যশোর-চুয়াডাঙ্গা বা রংপুর-দিনাজপুরে তা সক্রিয় ছিল। কিন্তু এবার তা দেশের বেশির ভাগ এলাকায় একই সঙ্গে টানা ১০-১১ দিন চলছে।’