কিশোরটির বাঁচার আকুতিতে সাড়া দেয়নি কেউ

আদনান ইসফার
আদনান ইসফার

বেলা আড়াইটা। ব্যস্ত সড়কের আশপাশে মানুষের জটলা। চার-পাঁচজন যুবক ধাওয়া করছেন এক কিশোরকে। যুবকদের একজনের হাতে পিস্তল, অন্যজনের হাতে ছুরি। একপর্যায়ে সড়কে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় ওই কিশোর। যুবকেরা প্রথমে তার মাথায় পিস্তল ঠেকান। এরপর পিঠে ছুরিকাঘাত করেন। রক্তমাখা শরীর নিয়েও দৌড়াতে থাকে সে। কিছুদূর গিয়ে লুটিয়ে পড়ে। কিশোরটি বাঁচার আকুতি জানালেও কেউ এগিয়ে আসেনি। মিনিট দশেকের মধ্যে এ কাণ্ড ঘটিয়ে চলে যান খুনি যুবকেরা। এরপর হাসপাতালে নিতে নিতে নিস্তেজ, ঠান্ডা শরীর। চিকিৎসক বললেন, ‘মৃত’।

গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের জামালখান মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে ঘটনার বর্ণনা জানা যায়। ঘটনাস্থল কোতোয়ালি থানার আওতাধীন। নিহত কিশোর আদনান ইসফারের (১৫) বাসা ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে। ঘটনার পরপর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া যুবকেরা চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আদনান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল। সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। পরিবারের সবার স্বপ্ন ছিল, সে বাবার মতোই প্রকৌশলী হবে।

কেন, কী কারণে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তা ধারণা করতে পারছেন না স্বজন ও সহপাঠীরা। প্রাথমিকভাবে পুলিশ বলছে, বন্ধুদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে দ্বন্দ্ব কী নিয়ে, তা এখনো স্পষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ।

আদনান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির শাহনগর এলাকার আখতার আজমের ছেলে। আখতার খাগড়াছড়িতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তবে তাঁরা নগরের জামালখান এলাকায় ‘আম্বিয়া সেরিন’ নামের একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে থাকেন। দুই ভাইবোনের মধে৵ আদনান ছোট।

ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে খাগড়াছড়ি থেকে রাত সাড়ে আটটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন বাবা আখতার আজম। তখনো হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের লাশঘরে রাখা ছিল আদনানের মৃতদেহ। ছেলের লাশ দেখে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এ সময় স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বুক চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘কীভাবে চলে গেলি বাবা। আমি কী নিয়ে বাঁচব।’

বিকেল থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আদনানের স্বজনেরা ভিড় করছিলেন। সেখানে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আদনানের ফুফু গুলজার আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের একটা মাত্র ছেলেকে মেরে ফেলল। ভাইরে কে দেখবে।’

কেন স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে খুন করা হলো, তার হিসাব মেলাতে পারছেন না স্বজনেরা। নিহত আদনানের খালু মাহাবুবুল আলম বলেন, কারও সঙ্গে আদনানের পরিবারের বিরোধ নেই। সে কোনো রাজনীতিতে জড়িত না। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলত। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কোনো বিরোধে এ ঘটনা ঘটেছে কি না, তাঁরা জানেন না। একই কথা জানালেন আদনানের খালাতো ভাই জাবেদ ওমরও।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইডিয়াল স্কুলের চার ছাত্র হাসপাতালে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তারা প্রথম আলোকে জানায়, স্কুল ছুটির পর তারা বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়। রাস্তার বিপরীত দিকে দেখতে পায় আদনানকে চার-পাঁচজন যুবক ধাওয়া করছেন। তাঁদের হাতে পিস্তল ও ছুরি ছিল। একপর্যায়ে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। একজন আদনানের মাথায় পিস্তলও ঠেকান। ছুরিকাঘাতের পরও সে আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে চলে আসে। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। যুবকেরা চেরাগী মোড়ের দিকে চলে যান। সে চিৎকার করলেও কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

গতকাল স্কুলে যায়নি আদনান। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসে। তবে কেউ তাকে ফোন করে ডেকেছে, নাকি স্বেচ্ছায় রাস্তায় আসে, তা জানাতে পারেননি স্বজনেরা। ঘটনার পর বিকেলে আদনানের বাসায় গেলে স্বজনেরা গণমাধ্যমকর্মীদের ঢুকতে দেননি।

নিহত ছাত্রের সহপাঠী কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শেখ ফাহিম গতকাল বিকেলে হাসপাতালে বলে, তারা বুঝতে পারছে না কেন আদনানকে খুন করা হলো। কারও সঙ্গে তার বিরোধ ছিল না। সোমবার রাতে আদনানের সঙ্গে তার কথা হয়। কেউ তাকে হুমকি দিয়েছে কিংবা কোনো সমস্যায় আছে, এ রকমও কিছু জানায়নি।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ভিডিওচিত্র দেখে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত এবং গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। কী কারণে এই খুন, তা তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।

আদনানের লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরে রয়েছে। আজ বুধবার হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

আদনান হত্যার সাড়ে তিন মাস আগে নগরের সদরঘাট থানার নালাপাড়ায় সুদীপ্ত বিশ্বাস নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চলে যাওয়ার সময় হত্যাকারীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়।

সুদীপ্ত নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলেন। গত বছরের ৬ অক্টোবর এই হত্যাকাণ্ডে সুদীপ্তর বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস থানায় মামলা করেন। কিন্তু খুনিরা ধরা না পড়ায় হতাশ তিনি। বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বলেন, সিনেমার দৃশ্যের মতো গাড়িবহর নিয়ে এসে এতগুলো লোক তাঁর ছেলেকে হত্যার পর গুলি ছুড়ে পালিয়ে গেল। আর পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।

পুলিশ বলছে, সুদীপ্ত হত্যাকাণ্ডে ৩০ জন অংশ নেয়। এই ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি।

 এ ছাড়া গত বছরের ৩ ডিসেম্বর নগরের কদমতলী এলাকায় তরুণ পরিবহন ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদকে তাঁর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার এবং মামলার কোনো কিনারা হয়নি। গ্রেপ্তার হয়নি একজন আসামিও।