সবজি খালা বলে তাঁকে ডাকে পাড়ার লোকে

সাবিনা ইয়াসমিন
সাবিনা ইয়াসমিন

পরনে ময়লা তেলচিটে কাপড়। ভ্যানবোঝাই হরেক রকমের কুড়িয়ে আনা শাকসবজি। এই ভ্যান চালিয়ে তিনি যান বাজারে, পাড়া-মহল্লায়। কখনো ঠেলে ঠেলে এপাড়া–ওপাড়ায় ঘুরে বেড়ান। বিক্রি করেন শাকসবজি। পাড়ার লোকে তাঁকে সবজি খালা বলে ডাকে। নাম তাঁর সাবিনা ইয়াসমিন। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। ১২ বছর ধরে শাকসবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

সাবিনা মাগুরার শালিখা উপজেলার রামানন্দকাঠি গ্রামের মৃত দলিল উদ্দীন মোল্যার মেয়ে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন নড়াইল পৌরসভার বরাশুলা গ্রামে প্রয়াত স্বামীর বাড়িতে। ভিটেমাটি ছাড়া সহায় সম্পত্তি নেই।

সাবিনা বলেন, প্রায় ৪০ বছর আগে বরাশুলা গ্রামের সেকেন্দার শেখের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সেকেন্দার তখন ভ্যান চালাতেন। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে হয়। এরপর প্রায় এক যুগ আগে সেকেন্দার আরেকটি বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। সাবিনা কিংবা তাঁর সন্তানদের কোনো খোঁজখবর নেন না। ভরণপোষণের খরচও দেন না।ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সাবিনা পড়েন অকূলপাথারে। কী খাবেন, কী পরবেন—এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। এর মধ্যে বড় মেয়ে অসুখে পড়ে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। বিনা চিকিৎসায় মেয়ে মারা যায়। তিনি খুব কষ্ট পান। এরপর ভাবেন, কিছু একটা করবেন। নিজের ও ছেলে-মেয়েদের মুখে অন্ন জোগাবেন। আর কাউকে মরতে দেবেন না। এই শুরু শাকসবজি বিক্রির কাজ। শুরুতে জড়তা ছিল, ছিল লোকলজ্জার ভয়। লোকে বাঁকা চোখে তাকাতেন। কিন্তু তিনি থেমে যাননি।

সাবিনা আরও বলেন, প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। এরপর নিজের ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। খালবিল, পুকুর থেকে শাপলা, কলমি, হেলেঞ্চা এবং বাগান থেকে কচু, কচুর ডগা, কচুর লতি, ঘাটকোল, থানকুনি পাতা সংগ্রহ করেন। এরপর ভ্যান চালিয়ে এসব নিয়ে যান স্থানীয় বাজারে। সেখানে কিছু সময় বিক্রি করেন। এরপর যান পৌর এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে। এত দিনে বাসাবাড়ির মানুষগুলোর মুখ তাঁর মুখস্থ। এসব চেনা মুখ দেখে তাঁর ভালো লাগে। বিশেষ করে লোকে যখন তাঁকে সবজি খালা বলে ডাকে, তখন তিনি সব দুঃখ ভুলে যান। মন তাঁর আনন্দে ভরে ওঠে।

সাবিনা ইয়াসমিনের তিন ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে। বড় ছেলে সাকিবুর রহমান দশম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে রাকিবুল ইসলাম নবম শ্রেণিতে আর ছোট মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তাদের ঘিরে স্বপ্ন দেখেন। ওরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। তিনি বলেন, ‘এত কষ্টের জীবন, আল্লাহ নিশ্চয়ই মুখ তুলে তাকাবেন। আমি তো কারও কাছে ভিক্ষা চাই না। শাকপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করি। আমার খুব চাওয়া–পাওয়া নেই। তবে আমার বড় ছেলে সাকিবুর স্বপ্ন দেখে, একদিন চিকিৎসক হবে। তার বুবুর মতো কাউকে আর বিনা চিকিৎসায় মরতে দেবে না।’