আগে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ জরুরি
রোহিঙ্গাদের তড়িঘড়ি করে নয়, স্বেচ্ছায় রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে সেখানে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে আটকে পড়া কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া আর প্রত্যাবাসন শুরুর আগে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো বন্ধ করা নিশ্চিত করতে বলেছে। গত মঙ্গলবার দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া মাঠপর্যায়ের চুক্তিতে বিষয়গুলো এসেছে।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার নেপিডোতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) প্রথম বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা অতীতেও ফিরে গিয়ে আবার বাংলাদেশে চলে এসেছে। এবার তো তাদের অধিকাংশেরই ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই প্রথম দফায় যেসব রোহিঙ্গা ফিরে যাবে তারা যেন দ্রুত নিজেদের আদি আবাসের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে থাকতে পারে, নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে—এ বিষয়গুলো জরুরি। প্রথম দফায় যারা ফিরবে, রাখাইনে তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের প্রভাবিত করবে। এ জন্য রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ফেরত পাঠাতে পরিবেশ তৈরিতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের মাঠপর্যায়ে চুক্তি সইয়ের পর এবার তা বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যেই চুক্তির খসড়া নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) কথাবার্তা শুরু করেছে। তবে প্রত্যাবাসনের এই কাজে জাতিসংঘের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে যুক্ত করবে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইউএনএইচসিআরের সম্পৃক্ততা নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল বুধবার তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এ নিয়ে ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত করছি এবং এ জন্য আলোচনা করছি। ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট নামের যে মাঠপর্যায়ের চুক্তিটি করেছি তাতে সেটা স্পষ্ট করে বলা আছে, রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর তা ইউএনএইচসিআরকে দেবে বাংলাদেশ। এরপর তাদের ফেরত পাঠানোতে যুক্ত হবে সংস্থাটি। আর প্রয়োজন হলে মিয়ানমার সংস্থাটির সহায়তা নেবে।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, শুধু ইউএনএইচসিআরই নয়, জাতিসংঘের যেকোনো সংস্থাকে যুক্ত করতে এখনো দ্বিধায় আছে মিয়ানমার। দেশটি প্রত্যাবাসনের কাজে আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে যুক্ত করতে চায়।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চুক্তি সইয়ের পরপরই তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এ ধরনের কাজে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে ইউএনএইচসিআরকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করা উচিত।’
এক দশকের বেশি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে গুতেরেস মন্তব্য করেছেন, এ ধরনের প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার চুক্তিতে ইউএনএইচসিআরকে একটি পক্ষ হিসেবে যুক্ত করা হলেও এখানে সেটি মানা হয়নি। তিনি বলেন, ‘লোকজনকে যদি বাংলাদেশের শিবির থেকে মিয়ানমারের শিবিরে সরিয়ে নেওয়া হয়, সেটি হবে সবচেয়ে বাজে ঘটনা।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর আগে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। গতকাল ওয়াশিংটনে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নুয়ার্ট বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে সময়সীমার চেয়ে বেশি জরুরি তাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে পাঠানো। লোকজন নিরাপদ বোধ না করলে আমরা তাদের ফেরত পাঠাতে চাই না। এটা হিতে বিপরীত হবে।’
প্রত্যাবাসন ফরমে যা থাকছে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় আবেদনপত্র চূড়ান্ত করাকে বড় অগ্রগতি বিবেচনা করছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। কারণ, এটি চূড়ান্ত হওয়ায় এখন প্রত্যাবাসনের কাজে সময় বাঁচবে। তাঁদের কারও কারও মতে, এর ফলে এখন পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময়ে তালিকা তৈরি করা যাবে।
চূড়ান্ত হওয়া কয়েক পৃষ্ঠার ওই আবেদনপত্রে দেখা গেছে, শুরুতে পরিবারের প্রধানের তথ্য রয়েছে। এতে পরিবারপ্রধানের নাম, লিঙ্গ, জন্মস্থান, বাবা-মায়ের নাম, স্ত্রীর নাম, জন্মতারিখ, মিয়ানমারে ঠিকানা, মিয়ানমারে বাবার ঠিকানা, মিয়ানমারে মায়ের ঠিকানা, মিয়ানমারে স্ত্রীর ঠিকানা, পেশা, বিশেষ শারীরিক চিহ্ন, বাড়ির নম্বর (যদি থাকে) এবং পরিবারের সদস্যসংখ্যা কত। আবেদনপত্রে তাঁর ছবি, পরিবারের অন্য সদস্যের ছবি (ঐচ্ছিক), একটি পুরো পরিবারের ছবি, পাঁচ বছরের ওপরে প্রত্যেকের ডান ও বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ দিতে হবে।
একই আবেদনপত্রে পরিবারের সদস্যদের যে তথ্য দিতে হবে সেগুলো হচ্ছে পুরো নাম, বাবা-মায়ের নাম, জন্মতারিখ, জন্মস্থান, লিঙ্গ, শারীরিক চিহ্ন, পরিবারপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক, বাড়ির নম্বর (যদি থাকে), অন্য কোনো দলিল (যদি থাকে)।
এই আবেদনপত্র পূরণ করে মিয়ানমারকে দেবে বাংলাদেশ। সম্ভব হলে দুই মাসের মধ্যে মিয়ানমার তা যাচাই শেষ করে বাংলাদেশকে ফেরত দেবে। এর চার সপ্তাহের মধ্যে পরিবার অনুযায়ী তাদের প্রত্যাবাসন হবে।