কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর কথা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীরা দৈনন্দিন জীবনে নানা সমস্যায় পড়েন। পড়াশোনা করতে গিয়ে, রাস্তায় চলাফেরা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাধা পার হতে হয় তাঁদের। কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জানিয়েছেন এসব সমস্যার কথা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাংবাদিক নাজিয়া হোসেন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জয়নব খাতুন বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। পরীক্ষা দেওয়ার সময় তাঁরা অনেকেই শ্রুতিলেখক পান না। অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়াটাও বেশ জটিল। এ ক্ষেত্রে কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পরীক্ষার দুই থেকে এক দিন আগে প্রথমে লিখিত আবেদনপত্র দিতে হয়। বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিললে পরে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে পরীক্ষার্থীকে যেতে হয়। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে তবেই পরীক্ষার্থী অনুমতি পান। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। মানসিক চাপে থাকতে হয়।

এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার কথা; সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও শ্রুতিলেখক নিয়ে সমস্যায় পড়েন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা। প্রথম শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষায় নির্ধারিত সময় তিন ঘণ্টার মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের লেখা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, পরীক্ষার্থী বলেন আর শ্রুতিলেখক তা শুনে শুনে লেখেন। তাই সময় বাড়ানো প্রয়োজন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাজমা আরা বেগম চলাফেরার ক্ষেত্রে তাঁর সমস্যার কথা জানিয়েছেন। যাত্রীবাহী বাসগুলোয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট আসন বরাদ্দ থাকে। কিন্তু তাঁদের সেখানে বসতে দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পক্ষে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বাসে ওঠানামা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই যেকোনো স্থান থেকে তাঁদের বাসে ওঠানামার ব্যবস্থা করার দাবি জানান নাজমা।

নাজমা আরও বলেন, ফুটপাতের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের। ফুটপাতে দোকানপাট বসে। লোকের ভিড়ও থাকে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা প্রায়ই লোকজনের ধাক্কার শিকার হন। এমনকি পড়ে গিয়ে অনেক সময় তাঁদের চলাচলের সঙ্গী সাদা ছড়িও ভেঙে যায়। অনেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের প্রতি নানা কটূক্তি করেন। যেমন: ‘আপনারা হাঁটেন কেন?’, ‘ঘরে বসে থাকতে পারেন না?’ এতে মানসিকভাবে আরও কষ্টের মধ্যে পড়েন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা। ফুটপাতের পাশে ড্রেন থাকলে তাতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের। অনেক জায়গায় ড্রেনের ঢাকনা খোলা থাকে। তাই এটি বেশ বিপজ্জনক। রাস্তা পার হওয়ার সময় বেশির ভাগ ট্রাফিক পুলিশ সাহায্য করে না বলেও জানালেন নাজমা।

পড়াশোনার অসুবিধার কথা জানালেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তাসলিমা সুলতানা। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের ব্রেইল বই সহজলভ্য নয়। কারণ, ব্রেইল বই ছাপানো অনেক ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় বইগুলো অ্যাপস হিসেবে তৈরি করলে অটো টিটিএসের মাধ্যমে পড়া সহজ হয়। ক্লাসে শিক্ষক পড়ানোর সময় বোর্ডের লেখা দেখতে পারেন না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা। তাই শিক্ষকের কথা রেকর্ড করার অনুমতি দিলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা উপকার পাবেন।

তিনজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীই জানান, তাঁদের বিনোদন প্রয়োজন। তাঁরা খেলাধুলায় অংশ নিতে চাইলেও সুযোগ দেওয়া হয় না। তাঁদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে চায় না বন্ধুরা। পুরো জীবনটাই একঘেঁয়েভাবে কাটে তাঁদের।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা চান, সরকার, সমাজ, জনগণ একটু সচেতন হোক। তাঁদের প্রতি মানসিকতা বদলাক। তাহলে তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়।