যাঁরা আছেন তাঁরাও ক্লাসে অনিয়মিত

শিক্ষকের মোট ৫৮টি পদের মধ্যে ২০টিই শূন্য। যাঁরা আছেন তাঁরাও নিয়মিত ক্লাস নেন না। ওই ২০ জনের মধ্যে অন্তত ৬ জন সিলেটে থাকেন। তাঁরাসহ অনেকেই সপ্তাহে তিন-চার দিন কলেজে আসেন। কেউ কেউ তিন দিনের ছুটি নিয়ে সপ্তাহ পার করে দেন। অধ্যক্ষ নিজেও কলেজে অনিয়মিত।

এ অবস্থা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের। নিয়মিত পাঠদান না হওয়ায় আট হাজার শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ছেন। এই কলেজপড়ুয়া মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন এক অভিভাবক সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বসেন, যা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছিল।

কলেজে নিজে নিয়মিত উপস্থিত না থাকার বিষয়টি অস্বীকার করছেন অধ্যক্ষ মো. আব্দুছ ছত্তার। তবে শিক্ষকদের কেউ কেউ অনিয়মিত, সিলেট থেকে আসা-যাওয়া করেন, তিন দিনের ছুটি নিয়ে ছয় দিন কাটান—এসব তিনি স্বীকার করেন। আব্দুছ ছত্তার প্রথম আলোকে বলেন, সুনামগঞ্জ প্রান্তিক জেলা। এখানে শিক্ষকেরা এসে থাকতে চান না। কলেজে ২৬টি শ্রেণিকক্ষের দরকার, কিন্তু আছে মাত্র ১৪টি। এ কারণেও নিয়মিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না।

১৩ বিষয়ের ক্লাস

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় আট হাজার। বিষয় আছে ১৩টি। ২০০১ সালে এখানে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু হয়। চালু আছে চারটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ মিলে শিক্ষকের পদ আছে ৫৮টি। কিন্তু এখন কর্মরত আছেন ৩৮ জন। এর মধ্যে দুজন শিক্ষকের সম্প্রতি অন্যত্র বদলির আদেশ হয়েছে।

কলেজের ইংরেজি বিষয়ে চারজন শিক্ষক আছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে যোগদান করেছেন। এর আগে দুজন শিক্ষক দিয়ে চলছিল একাদশ, দ্বাদশ, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডিগ্রি শ্রেণির ইংরেজির পাঠদান। নতুন দুজনের মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক ভুবনজয় আচার্য যোগদানের পর থেকেই কলেজে অনিয়মিত বলে অভিযোগ রয়েছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে ভুবনজয় বলেন, ফোনে তিনি কোনো কথা বলবেন না। সশরীরে দেখা করার পরামর্শ দেন তিনি।

কলেজের রসায়ন, পদার্থ, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও দর্শন বিভাগে চারটি পদের স্থলে শিক্ষক আছেন দুজন করে। ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষক আছেন তিনজন করে।

কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষকদের মধ্যে অনন্ত ছয়জন আছেন, যাঁরা সিলেটে থাকেন। একজন আসেন হবিগঞ্জ থেকে। এই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে খুব একটা মনোযোগী নন। কলেজে এসে গল্পগুজব করেই সময় কাটান বেশি। আবার সিলেট বিভাগের বাইরের শিক্ষকদের কেউ কেউ তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেলে আসেন সপ্তাহ পার করে। কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বেশি। অধ্যক্ষ নিজেই সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন কলেজে উপস্থিত থাকেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধ্যক্ষের অনিয়মিত উপস্থিতির সুযোগ নেন অন্য শিক্ষকেরা। নিজের দুর্বলতার কারণে অধ্যক্ষ অন্য শিক্ষকদের কিছু বলতে পারেন না। হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া অন্যরা আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকেন। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত ক্লাস না হওয়ার বিষয়টি অধ্যক্ষকে জানিয়েও লাভ হয়নি। তিনি শুধু শিক্ষক-সংকট, শ্রেণিকক্ষের অভাব দেখান।’

এ অবস্থায় গত ৩০ নভেম্বর এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর। তাঁর মেয়েও এই কলেজে পড়াশোনা করেন। মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন মালেক হুসেন জেলা প্রশাসকের অফিস কক্ষের সামনের বারান্দার মেঝেতে আড়াই ঘণ্টা বসে প্রতিবাদ জানান।

পৌর শহরের তেঘরিয়া এলাকার বাসিন্দা মালেক হুসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউকে না কাউকে তো কথা বলতে হবে। প্রতিবাদ জানাতে হবে। শুধু আমার মেয়ের জন্য নয়, আমি কলেজের সব শিক্ষার্থীর জন্য এটা করেছি। জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এই সরকারি কলেজ এভাবে চলতে পারে না।’

প্রতিবাদেও প্রতিকার নেই

মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেনের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং কোচিং-বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে ৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে মানববন্ধন করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুপ্রেরণায় গঠিত জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক)। সকালে পৌর শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ওই কর্মসূচিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন অংশ নেন।

জেলা দুপ্রকের সভাপতি নুরুর রব চৌধুরী বলেন, এই কলেজে জেলার প্রত্যন্ত হাওর এলাকার গ্রাম থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার যে পরিবেশ, সংকট ও ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেটি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। প্রতিষ্ঠানটি তার অতীত গৌরব হারাতে বসেছে।’

এমনকি সরকারি কলেজের এ অবস্থা নিয়ে জেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির একাধিক সভায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই ইতিবাচক ফল আসেনি।

পৌর শহরের হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, ‘কলেজের সংকটের বিষয়টি আমরা জানি। এ নিয়ে জেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির দুটি সভায় আলোচনা করেছি। এসব সভায় অধ্যক্ষর উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায় না। কলেজের কোনো প্রতিনিধি আসেন না। আসলে সমস্যার সমাধানে কলেজ কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।’

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন ৫ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত আবেদন দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৪ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির নেতৃত্বে আছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. শফিউল আলম।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘কলেজটির শিক্ষার মানোন্নয়নে কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে যে সহযোগিতা চাইবে আমরা করব। তারা চাইলে আমরা শিক্ষকদের উপস্থিতির ডিজিটাল সিস্টেম চালু করে দিতে পারি।’