বছরে ইয়াবার বাণিজ্য ৬ হাজার কোটি টাকা

উদ্ধার হওয়া ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি
উদ্ধার হওয়া ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও ছোট্ট আকারের এই বড়ি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্ধার হওয়া ইয়াবা বড়ির সংখ্যা বছরে প্রায় চার কোটিতে এসে ঠেকেছে।

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) মতে, উদ্ধার হওয়া মাদকের এই সংখ্যা বিক্রি হওয়া বড়ির মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা দাম হিসেবে)। এই টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে।

হিসাব করে দেখা গেছে, ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ (২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিজিবির বাজেট ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা)। আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক।

আর্থিক, সামাজিক, মানবিক—নানাভাবে ইয়াবার আগ্রাসন দেশজুড়ে ছড়ালেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ খুব সামান্য। ইয়াবা বন্ধে মাদকদ্রব্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ছাড়া আর কোনো তৎপরতা নেই। অন্য বাহিনীগুলোর তৎপরতা শুধু উদ্ধারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ জানুয়ারি পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মাদক নির্মূলের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইয়াবা পরিবার ও সমাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে।

এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ কার্যালয়ে সীমান্ত এলাকার সাংসদদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ওই বৈঠকে সব সাংসদই মাদক নির্মূলের ব্যাপারে জোর দেন। কিন্তু সরকারের এসব কর্মকাণ্ডের কোনো প্রভাবই নেই মাঠপর্যায়ে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ৬ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা ইয়াবা। ইয়াবা আসছে প্রতিবেশী দেশ থেকে। এটা কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের সংখ্যাও অনেক। তাঁর মত, শুধু পুলিশ দিয়ে মাদক নির্মূল করা কঠিন।

মাদক নির্মূলে সরকারের সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, মাদক পরিস্থিতি এখন তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিশেষ করে ইয়াবার বিক্রি ও ব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের তথ্যমতে, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে ইয়াবা সরবরাহ করে মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। ২০১২ সালে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির পর মিয়ানমারের মাদক উৎপাদনকারীদের জন্য সেসব দেশে পাচার কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা বাংলাদেশকেই
মাদক পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। মিয়ানমারে ওয়া এবং কোকাং নামের আদিবাসী সম্প্রদায় এই মেথাএম্ফিটামিন পিল বা ইয়াবার উৎপাদনকারী। এই দুই গোষ্ঠীর লোকজন একসময় আফিম ও হেরোইন উৎপাদনে জড়িত ছিল।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৭ জুনে প্রকাশিত) পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়, ২০০৮-এর তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৫ তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

এতে বলা হয়, ২০১২ সালে মোট মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৫টি স্থান দিয়ে ইয়াবা পাচার হচ্ছে বলে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ২০১১ সালে জব্দ হওয়া ইয়াবার পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৬০ হাজার, আর ২০১৬ সালে হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ। আর ২০১৭ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ ৯১ হাজার।

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ এ সংখ্যা মানতে নারাজ। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মোট বিক্রি হওয়া মাদকের ২০-২৫ শতাংশই ধরা পড়ে। বাকি ৭৫ শতাংশ মাদকসেবীদের কাছে চলে যেতে পারে। তিনি দাবি করেন, নিয়মিত অভিযানের কারণেই মাদক উদ্ধার হচ্ছে।

সিআইডির ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের কমান্ড্যান্ট শাহ আলম মাদক নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০১০ সালে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখে। এদের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে করে প্রতি ১৭ জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত বলে ধরে নেওয়া যায়। তিনি বলেন, মাদকসেবী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে।

সাম্প্রতিক বড় চালান

দেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান ধরা পড়ে ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি। র‍্যাব-৭-এর একটি দল পতেঙ্গা বহির্নোঙর থেকে ২৮ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে। এই বিপুল পরিমাণ ইয়াবার মালিক চট্টগ্রামের একুশে প্রপার্টিজ নামের একটি হাউজিং প্রতিষ্ঠানের মালিক আলী আহমেদ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহকারী মহিউদ্দিন ও হামিদুল্লাহ। এই চালানের ইয়াবা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। এঁদের তিনজনই গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে আছেন।

২০ লাখ ইয়াবার চালান আটক করা হয় গত বছরের ১৬ এপ্রিল। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা ‘দানবীর’ বলে পরিচিত মোহাম্মদ মোজাহের এই চালান আনেন। এ ঘটনায় ৮ জনকে আটক করা হয়। সেখানকার একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, মোজাহের গ্রেপ্তারের পর তাঁর পরিবারের কেউ আর আনোয়ারায় থাকেন না। ছেলে-মেয়েরা বিদেশে থাকেন।

গত বছরের ২৩ জুন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সি-বিচ থেকে ১৫ লাখ ইয়াবাসহ একটি ট্রলার আটক করে র‌্যাব। এ সময় মিয়ানমারের ৫ নাগরিকসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জব্দ হওয়া ইয়াবার চালানটি পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ ফারুকের। তিনি বাইট্টা ফারুক ওরফে বিচ্চু ফারুক নামে পরিচিত ছিলেন। ইয়াবা চালানের সঙ্গে জব্দ করা ট্রলারটির মালিকও তিনি, আর ট্রলারের মাঝি ছিলেন নজির আহমেদ। তাঁরা এর আগে তিন দফায় ১০ লাখ করে মোট ৩০ লাখ ইয়াবা আনার কথা স্বীকার করেন। গত বছরের ২০ অক্টোবর র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ফারুক নিহত হন।

গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর শাহপরীর দ্বীপে ৮ লাখ ইয়াবাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। বদি আলম নামে মিয়ানমারের এক ব্যবসায়ী চালানটি পাঠান। ১৯ মার্চ ধরা পড়ে ৬ লাখ ইয়াবার চালান। আনোয়ারার হাসান মাঝি ও সাবের মাঝি নামের দুই ভাই এর মালিক ছিলেন।

গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ধরা পড়েন ৫ লাখ ইয়াবা চালানে জড়িত কক্সবাজারের ব্যবসায়ী সুলতান আহমেদ। আর এ বছরের ৫ জানুয়ারি ৫ লাখ ইয়াবার যে চালান ধরা পড়েছে, তা এনেছিলেন পটিয়ার ব্যবসায়ী ইউসুফ আহমেদ। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

এখনো পাচার চলছে

গত ২৫ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হওয়ার পর সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করেছিলেন, ইয়াবা পাচারও কমে যাবে। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়ন করে দিলেও ইয়াবা চোরাচালান ঠিকই চালু থেকেছে। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০৬ জন মিয়ানমারের নাগরিক ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় ৫৩টি মামলা হয়েছে।

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) কিছু কর্মকর্তা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাদক প্রতিরোধে গত বছরের ১৯-২১ আগস্ট মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বৈঠকের সময় ইয়াবা কারখানা এবং এর মালিকদের একটি তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমার ওই তালিকার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। এর আগেও দেশটি ইয়াবা বন্ধে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। তিনি বলেন, ইয়াবা যে মিয়ানমার থেকে আসছে, এটা তারা মানতেই চায় না।

টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইয়াবার উৎপাদন ও বাজারজাত পুরোপুরি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বিজিবির এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সংসদ ও দেশটির শান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, মংডু ও বুথিডং এলাকার সীমান্তরক্ষী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, কাস্টমস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৬টি স্থানে ৪৯টি কারখানাও গড়ে তোলা হয়েছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা একসময় ছিল বিত্তবান পরিবারের ছেলেদের নেশার উপকরণ। এখন দাম কমে যাওয়ায় তা সাধারণের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। নিম্নবিত্ত বা সাধারণ পরিবারের ছেলেরাও ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে।

এই মারাত্মক প্রবণতা বন্ধ করতে সমন্বিত অভিযান চালানোর পরামর্শ দিয়ে সাবেক মহাপরিদর্শক বলেন, তা না হলে দিনে দিনে মাদক পরিস্থিতি জঙ্গির চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।