আর্সেনিকের তথ্য চেপে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর!

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘হেলথ বুলেটিন ২০১৭ ’-এ আর্সেনিকের তথ্য নেই। গত মাসের শেষ সপ্তাহে বার্ষিক এই প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)। ২৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে আর্সেনিকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বা তাদের চিকিৎসা-পরিস্থিতি নিয়ে তথ্য নেই। স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই দলিলে আর্সেনিকের তথ্য চেপে যাওয়াকে দুঃখজনক বলেছেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। 

এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত মৌলিক তথ্যসংবলিত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস। নীতিনির্ধারক, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এই তথ্য ব্যবহার করেন। স্বাস্থ্যের সরকারি তথ্যের এটাই অন্যতম প্রধান নির্ভরযোগ্য উৎস। প্রতিবছরের প্রতিবেদনে দেশের আর্সেনিক পরিস্থিতি ও আর্সেনিকোসিস রোগীদের চিকিৎসায় সরকার কী করছে, তার বর্ণনা থাকে। ‘হেলথ বুলেটিন ২০১৭ ’-এ কিছু নেই।
এমআইএসের পরিচালক ও বুলেটিনের প্রধান সম্পাদক ডা. আশিস কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্সেনিক-সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ও কর্মকর্তার কাছে বারবার তাগাদা দিয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি কর্মসূচির আওতায় আর্সেনিক রোগীদের চিকিৎসার বিষয়গুলো দেখা হয়। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক (ডিপিএম) ডা. শাহনেওয়াজ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, এমআইএস থেকে তাঁর কাছে তথ্য চাওয়া হয়নি।

২০১৬-এর তথ্য: প্রতিবছরের মতো ‘হেলথ বুলেটিন ২০১৬ ’-তেও পৃথক বিষয় হিসেবে ‘ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপশম কর্মসূচি’ উপশিরোনামে আর্সেনিকের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। তাতে দেশে নলকূপের পানিতে প্রথম মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক শনাক্ত করার ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি বলা হয়, এখনো দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ঝুঁকিতে।
গত বছরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশে মোট পুঞ্জীভূত আর্সেনিকোসিস রোগী ছিল ৬৫ হাজার ৯১০ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ছিল সবচেয়ে বেশি (৩১ হাজার ২৩০ জন বা ৩৭ শতাংশ)।
সরকার এ ক্ষেত্রে কী করছে, তারও লম্বা তালিকা দেওয়া হয়। তালিকায় ছিল আর্সেনিক-সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধকরণ, মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপের আয়োজন, আর্সেনিকমুক্ত পানি পানের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ানো, নলকূপের পানি পরীক্ষা, বাড়ি বাড়ি আর্সেনিকোসিস রোগী খুঁজে দেখা, আর্সেনিকোসিস রোগী শনাক্ত করা ও রোগী ব্যবস্থাপনা, রোগী ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো, আর্সেনিকের কারণে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মানুষের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, আর্সেনিক বিষয়ে জরিপ ও গবেষণা করা, জাতীয় নীতি ও উপশম কৌশল হালনাগাদ করা, স্থানীয় মানুষ ও কমিউনিটির সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তোলা।
গত বছরের প্রতিবেদনে এত কর্মকাণ্ডের উল্লেখ থাকলেও এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। আর্সেনিক বিষয়ে নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্সেনিক হচ্ছে নীরব ঘাতক। দেশ থেকে আর্সেনিক সমস্যা দূর হয়নি। হেলথ বুলেটিনে আর্সেনিকের তথ্য না থাকা দুঃখজনক। আর্সেনিকোসিস রোগীদের সংখ্যা, পরিস্থিতি, চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগ জানার অধিকার সবার আছে।’
দুই বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যকে উদ্ধৃত করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, বাংলাদেশে প্রতিবছর আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার কারণে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যায়। এই তথ্যের প্রতিবাদ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু আর্সেনিকের কারণে কত মানুষের মৃত্যু হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিতে পারেনি।