খালেদার মামলার রায়ের পর দলের কৌশল নির্ধারণ

খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার বিচারকাজ এখন শেষ পর্যায়ে। এই মামলার রায়ের ওপর এ বছরের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তার অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে সরকার কোন ধরনের নির্বাচন করতে চায়, তা অনেকটা স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার ছেলে, বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানও আসামি। একই আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতির আরেকটি মামলার বিচারকাজও দ্রুত এগোচ্ছে। মামলা দুটি নিয়ে বিএনপির ভেতরে বড় উদ্বেগ আছে। এই মামলার রায়ের ওপর নির্ভর করছে দলটির পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল ও পদক্ষেপ কী হবে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলের কৌশল নির্ধারণেও খালেদা জিয়ার মামলার রায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে বলে জানা গেছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দুটিকে ‘নির্বাচনী ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহারের ছক কষে এগোচ্ছে সরকার। মামলা দুটিতে খালেদা জিয়ার সাজা হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এটাকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করবে। আবার খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য করে খণ্ডিত বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টাও হতে পারে, এমন আশঙ্কাও আছে দলটির ভেতরে।

খালেদা জিয়ার সাজা হলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে, তা এখনো ঠিক করেনি বিএনপি। তবে দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র হলে বিএনপি শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হলে বিষয়টি আর বিএনপির থাকবে না। কারণ, এর সঙ্গে নির্বাচনের, ভোটাধিকারের, গণতন্ত্র ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো সম্পৃক্ত। অগণতান্ত্রিক পরিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য জনমানুষের যে দীর্ঘ প্রত্যাশা, তা পূরণ হবে কি না, এর সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।

অন্যদিকে আদালতের রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে বিএনপির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির উচ্চপর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের সাজা হতে পারে। এ কারণে আওয়ামী লীগ জেলা পর্যায়ে নির্বাচনী সফর শুরু করতে যাচ্ছে, যাতে খালেদা জিয়ার মামলার রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দলকে প্রস্তুত রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগও ব্যাপকভাবে প্রচারের পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ না থাকলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট বা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার কথা নয়। এরপরও যদি সাজা হয়, তাহলে বিএনপি ধরে নেবে, সরকার আবারও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে। মামলার রায়ের পেছনে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ষড়যন্ত্রও আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবী, ডাক্তার, রাজনীতিক—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে বিচার চলছে, তা আইনের নিজস্ব গতিতে চলছে। একে প্রভাবিত করার কোনো পথ নেই। তিনি বলেন, রায় যা-ই হোক, এরপর তো উচ্চ আদালত আছে। এ নিয়ে নানান কথা বলে মূল ইস্যুকে অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা দুঃখজনক।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি মামলা আছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারকাজ দ্রুত এগোচ্ছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় এখন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ পর্যায়ে। এই মামলার জন্য বিশেষ এজলাসে সপ্তাহে তিন দিন করে আদালত বসছে। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আইনানুযায়ী আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য্য করবেন। রায়ের পর সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে আপিলের সুযোগ রয়েছে।

সরকারসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মামলা দুটির রায় সামনে রেখে সরকার নতুন আইন করার চিন্তাও করছে। যাতে কারও বিচারিক আদালতে সাজা হলে পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচনের জন্য তিনি অযোগ্য হন। এ লক্ষ্যে আইনের একটি খসড়া তৈরির কাজ চলছে। অবশ্য এই চিন্তা এখনো চূড়ান্ত নয়। এটা নির্ভর করবে সামনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, খালেদা জিয়ার মামলা দুটির সঙ্গে রাজনৈতিক, বিশেষ করে আগামী সংসদ নির্বাচনের সম্পর্ক আছে। এই মামলার রায় পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে প্রভাব ফেলবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ ধরনের মামলা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতার বিরুদ্ধেও হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তাঁরা নিজেদের মামলাগুলো তুলে নিয়েছেন।