সরকারের নজর বনের জমিতে

বন বিভাগ এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৯ দশমিক ৪৯ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে নতুন করে আরও ১৬ হাজার একর বনভূমি চেয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ৪ হাজার ৮৩৫ একর বনভূমিতে আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে গত ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের কাছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে বনভূমি বরাদ্দের এক আবেদনের ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে সরকার বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে চায়। এই আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, এভাবে বনভূমি বরাদ্দ দিতে থাকলে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ দুরূহ হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বন বিভাগের চিঠির এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামীকাল সোমবার কার্যালয়ের সভাকক্ষে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা থাকবেন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ বনাঞ্চল থাকার কথা, গত ১৫ বছরে তা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। তাই এখন বনগুলো সম্প্রসারণ করতে পারলে এসডিজি অর্জন লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে। কিন্তু তা না করে যদি এভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়, তবে কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করা যাবে না।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে মোট আয়তনের যে ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ বনভূমি আছে, তার মধ্যে মাত্র ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং আইন ও প্রজ্ঞাপনের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নের জন্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপনে বনভূমির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর অনুকূলে বনভূমি বরাদ্দের ফলে দেশের সীমিত বনভূমি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বন, বনভূমি,
পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিঘ্নিত হচ্ছে। বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র হ্রাস পাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে দেওয়া চিঠিতে রেললাইন, রাস্তা, ড্রেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, সীমান্তচৌকি (বিওপি) স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নে বনভূমি ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যদি বনভূমি ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ নেওয়া বনভূমির সমপরিমাণ জমি বন সৃজনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করে তা বন অধিদপ্তরের নামে বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানায়।

এই চিঠিটি যখন দেওয়া হয়, তখন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তিনি এখন পানিসম্পদমন্ত্রী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আলাদা আবাদি এসব জমি চাইছে। তবে কেউ চাইলেই আমরা এভাবে বনের জমি দিতে পারি না। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির জন্য আমরা বিষয়টি তাঁর দপ্তরের মুখ্য সচিবকে অবহিত করে চিঠি দিয়েছি। বনভূমি বরাদ্দের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যা বলবেন, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব।’

কোথাও সড়ক, কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

বস্ত্র পরিদপ্তর গাজীপুরের ‘কাপাসিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন’ প্রকল্পের জন্য পাঁচ একর জমি চেয়েছে। ওই বনভূমিতে গজারিগাছ আছে। কোস্টগার্ড গত ৫ মে এক আবেদনে পরিচালন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক একর ভূমি বরাদ্দ চায়। গত ১৮ আগস্ট করা আবেদনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) খাগড়াছড়ি জেলার বাবুছড়ার দিপুছড়ি, ধুপশীল ও উত্তর লক্কাছড়ায় সীমান্তচৌকি (বিওপি) স্থাপনের জন্য জমি বন্দোবস্ত চেয়েছে। এ ছাড়া নাইক্ষ্যংছড়ির বুচিডংয়ে বিওপি স্থাপনে জমি চাওয়া হয়েছে পাঁচ একর। জমি চাওয়া হয়েছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও পঞ্চগড় জেলায়ও। পার্বত্য এলাকায় ৫৪ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য ৩৯ দশমিক ৯৫ একর এবং ১৭ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের তল্লাশিচৌকি (চেকপোস্ট) স্থাপনের জন্য এক একর জমি, ভ্রাম্যমাণ সীমান্তচৌকি (ফ্লোটিং বিওপি) স্থাপনের জন্য অস্থায়ী জমি চাওয়া হয়েছে।

গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী এক চিঠিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জানিয়েছেন, বিজিবির ৫৪ গার্ড ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য সরকারের পূর্ব অনুমতি ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঘাইহাট এলাকায় ৬০ একর সংরক্ষিত বনে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বনজ সম্পদের ক্ষতি করে বুলডোজার দিয়ে পাহাড় কেটে হেলিপ্যাড, রাস্তা ইত্যাদি স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রয়োজনে নিরাপত্তাচৌকি বসানোসহ বিভিন্ন প্রয়োজনের নিরিখেই এ জমি চাওয়া হয়। এ বিষয়ে আমরা একটি নীতিমালাও করে দিয়েছি। বন বিভাগের উচিত নীতিমালা অনুসরণ করেই ব্যবস্থা নেওয়া।’

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও তা উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিভিন্ন জায়গায় শালবনের ক্ষতি করে অনুমোদনহীনভাবে রাস্তা ও পয়োনালা নির্মাণ করছে। এসব বিষয়ে সতর্ক করে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা বা পয়োনালা নির্মাণের সময় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সম্প্রতি এলজিইডির গাজীপুরের শ্রীপুরের গোসিংগা-রাজাবাড়ী রাস্তা, কাঁচিঘাটাও কালিয়াকৈরে বনভূমিতে বিভিন্ন রাস্তা ও পয়োনালা নির্মাণে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি বন বিভাগের পক্ষে সীমিত জনবল দিয়ে মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংরক্ষিত বনের গাছ নিধন, পাথর ও টিলা কেটে কক্সবাজারের টেকনাফ-শাপলাপুর সড়ক নির্মাণ করেছে এলজিইডি। এ নিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেও কোনো কাজ হয়নি। একইভাবে বান্দরবানেও সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণ করেছে এলজিইডি।

সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে সুষ্ঠু ভূমি ব্যবস্থাপনা ও নীতিমালা না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কঠোর হওয়া উচিত।

প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, বনভূমি অর্থ শুধু কিছু গাছপালা নয়। এর সঙ্গে বন্য প্রাণী ও সামগ্রিকভাবে জীববৈচিত্র্যের বিষয় জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই নানা কারণে বনভূমিগুলো বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাই বনভূমি রক্ষা করে অন্য কোথাও এ ধরনের স্থাপনার পরিকল্পনা করতে হবে।