মাতৃভাষায় পড়ার দক্ষতা বাড়লে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে

মাতৃভাষা বাংলায় পঠনদক্ষতা মানবসম্পদ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে পড়তে না পারলে শিক্ষার ভিত শক্ত হয় না। তাই শিশুর প্রথম শ্রেণি থেকে এই পঠনদক্ষতা বাড়ানোর কাজ শুরু হতে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার অভ্যাসও গড়ে তুলতে হবে।
গতকাল শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘মাতৃভাষার পঠনদক্ষতা: মানসম্মত শিক্ষার ভিত্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এই বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ইউএসএআইডি ও সেভ দ্য চিলড্রেন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, দেশের উন্নয়নে মানবসম্পদ সবচেয়ে বড় শক্তি। আর মানবসম্পদ গড়ে তোলার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায়নি। প্রাথমিকে নানা ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা থাকায় কোথাও ভালো শিক্ষা পাচ্ছে, কোথাও শিক্ষার মান হতাশার। শিক্ষাব্যবস্থায় যত দ্রুত অভিন্নতা আনা যাবে তত মঙ্গল।
শিক্ষার্থীদের প্রথম শ্রেণি থেকে পঠনদক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে মোস্তফা কামাল বলেন, পঠনদক্ষতা বাড়াতে পাঠ্যক্রমকে আকর্ষণীয় করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মানসম্পন্ন শিক্ষার অভীষ্ট অর্জন করা সহজ হবে না। এ জন্য প্রচুর কাজ করতে হবে। তবে সরকার লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। মাতৃভাষায় পঠনদক্ষতা মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনে মূল ভূমিকা পালন করবে।
মাতৃভাষায় পঠনদক্ষতা বাড়াতে শব্দের ভান্ডার বাড়াতে হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জীনাত ইমতিয়াজ আলী। তিনি বলেন, ‘আমরা যা পড়ি তা আমাদের স্মৃতি থেকে। তাই আমাদের মাতৃভাষায় পঠনদক্ষতা অর্জন করতে হলে শব্দভান্ডার বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে।’

গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বক্তব্য দেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। পাশে জীনাত ইমতিয়াজ আলী l ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বক্তব্য দেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। পাশে জীনাত ইমতিয়াজ আলী l ছবি: প্রথম আলো

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতেই বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার পঠনদক্ষতার বর্তমান চিত্র, মূল্যায়নব্যবস্থা, ভিত্তিমূলক দক্ষতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ। ২০১৫ সালের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (এনএসএ) অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণি মান অনুযায়ী বাংলা পড়তে পারে না। পঞ্চম শ্রেণিতে তা বেড়ে হয় ৭৭ শতাংশ। মাতৃভাষায় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে পড়া ও লেখার সক্ষমতা অর্জনে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর দশম শ্রেণি লেগে যায়।
সেভ দ্য চিলড্রেনের উপপরিচালক শাহীন ইসলাম বলেন, পঠনদক্ষতার অনেক উপাদান আছে। ধ্বনি সচেতনতা, বর্ণজ্ঞান, শব্দভান্ডার বাড়ানো, সাবলীলভাবে পড়া এবং বোধগম্যতা অর্জন করা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই বিষয়গুলো অনুশীলন করতে শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে হবে। বার্ষিক মূল্যায়নে লেখার পাশাপাশি শোনা, বলা ও পড়াকেও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
কোন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা দ্রুত শিখবে-এটি নিয়ে গবেষণা করতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সৈয়দা তাহমিনা আক্তার। তিনি বলেন, বর্ণানুক্রমিক না উচ্চারণ-কোন পদ্ধতিতে শিশুদের ভাষা শিক্ষা শুরু হবে, সেটি বিবেচনা করতে হবে। ৬০ থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন শিক্ষক হলে প্রত্যেকের জন্য ভাষার পঠনদক্ষতায় আলাদা যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
শিশুদের পঠনদক্ষতা বাড়াতে শিক্ষকদের দক্ষতাও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ইফ্ফত আরা নাসরিন মজিদ। তিনি বলেন, শিক্ষার ভিত্তি গড়ে ওঠে প্রাথমিক পর্যায়ে। সেখানকার শিক্ষকদের ভিত্তি দুর্বল হলে শিশুদের পঠনদক্ষতা গড়ে ওঠে না। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকগুলোও আকর্ষণীয় নয়।
ইউএসএআইডির শিক্ষাবিষয়ক দলনেতা কেট মেলনি বলেন, শিশুদের পাঠদক্ষতা ১০ শতাংশ বাড়লে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে যায়। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে মাতৃভাষায় পাঠদক্ষতা বাড়াতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে হলে মানবসম্পদ লাগবেই। আর মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া এই মানবসম্পদ তৈরি হবে না।
মাতৃভাষায় মানসম্মত শিক্ষার ভিত্তি গড়তে হলে ভালো গবেষণা জরুরি বলে মনে করেন ব্র্যাক এডুকেশন প্রোগ্রামের হেড অব পার্টনারশিপ অ্যান্ড প্রজেক্ট মো. মনোয়ার হোসেন খন্দকার। তিনি বলেন, পঠনদক্ষতা বাড়াতে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, শিক্ষাক্রম কেমন হবে-এসব বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে।
সিসেমী ওয়ার্কশপ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ছয়টি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটি বিষয় বাংলায় পড়তে হয়। বাংলায় পঠনদক্ষতা না থাকলে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
মাতৃভাষায় অনুধাবনের বিষয়টি ছোটবেলাতেই বোঝাতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফোরাম ফর এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী সম্পাদক নাজমুল হক। তিনি বলেন, কোন শ্রেণিতে বাংলা ভাষায় মিনিটে কতগুলো শব্দ পড়তে হবে, সেটি নির্ধারণ করা জরুরি। শ্রেণি অনুযায়ী পৃথক শব্দভান্ডার থাকতে হবে।
ইউএনডিপির অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের পলিসি এক্সপার্ট মো. আফজাল হোসেন সারওয়ার বলেন, বর্তমানে যে শিখন-শেখানো পদ্ধতি আছে, সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে পঠনদক্ষতা গড়ে তুলতে পারে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পঠনদক্ষতা বাড়াতে সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।
পঠনদক্ষতা বাড়াতে বিদ্যালয়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের উপপরিচালক কে এম এনামুল হক। তিনি বলেন, প্রথম পাঁচ বছরে শিক্ষার্থীরা যেন অন্তত ১০০ বই পড়তে পারে। এ জন্য বিদ্যালয়গুলোতে পাঠাগার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
পরিবার থেকেই পঠনদক্ষতা তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমান পাঠ্যপুস্তকগুলো সাবলীল নয়। পড়তে আনন্দ লাগে না। শিক্ষার্থীদের যে বই দেওয়া হয়, সেগুলো তাদের উপযোগী কি না, তা দেখতে হবে।
সেভ দ্য চিলড্রেন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পঠনদক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন জেলার ৫ হাজার ১১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রিডিং এনহেন্সমেন্ট ফর অ্যাডভান্সিং ডেভেলপমেন্ট (রিড) নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। যার মাধ্যমে প্রথম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পঠনদক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
মাগুরা সদরের কাসুন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে ছয়টি বিষয় পড়াতে হয়। পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব তৃণমূলের শিক্ষকদের। রিডের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের পঠনদক্ষতায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে আসা অভিভাবক জ্যোতি আক্তার বলেন, তাঁর দুই ছেলের ছোটজন রিড কার্যক্রমের সুযোগ পেয়েছে। সে এখন সাবলীলভাবে পড়তে পারে। কিন্তু তার বড় ছেলের বাংলা পড়তে জড়তা কাজ করে। তিনি দেশের সব স্কুলে পঠনদক্ষতা বাড়াতে রিডের মতো কার্যক্রম শুরুর দাবি জানান।