উন্নয়নের জন্য প্রাণিজ সম্পদকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। পাশে পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব  শামসুল আলম l ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। পাশে পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম l ছবি: প্রথম আলো

খাদ্যনিরাপত্তা তৈরি, সুষম পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়ন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাণিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর এই সূচকগুলো জাতিসংঘের এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই এ খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজির দারিদ্র্য দূরীকরণ, ক্ষুধা দূর করা, সুস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।

গতকাল সোমবার প্রথম আলো ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আয়োজিত ‘২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন।

 গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সাংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, বর্তমানে দেশে নিকট অতীতের চেয়ে দুধের উৎপাদন ৩ গুণের বেশি, মাংস ৭ গুণের বেশি ও ডিমের উৎপাদন প্রায় ৮ গুণ বেড়েছে। সরকারের ভিশন-২০২১ অর্জনে জনপ্রতি প্রতিদিন দুধ ১৫০ মিলিলিটার, মাংস ১১০ গ্রাম এবং বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদা পূরণে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হলে তা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সহায়তা করবে।

মন্ত্রী ক্ষুদ্র খামারিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন এবং বেসরকারি খাতকে এ খাতের উৎপাদনে এগিয়ে আসার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে দুধ, ডিম ও মাংসের সুষম বণ্টনের প্রতি গুরুত্ব দেন। তবে অনেকেই সচেতনতার অভাব বা অভ্যাস নেই বলে আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও দুধ, ডিম খাচ্ছেন না বলে উল্লেখ করেন।

কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

আলোচনায় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, পোলট্রি কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু দেশে মাংস ও দুধ উৎপাদন পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। গ্রামীণ কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতের সঙ্গে জড়িত। ৪৪ শতাংশ আমিষ পাওয়া যাচ্ছে এ খাত থেকে। পুষ্টি, খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকেও খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না খাতটি।

শামসুল আলম এ খাতকে শুল্কমুক্ত করা, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি, খামারিদের বিমার আওতায় আনা এবং সর্বোপরি এ খাতে সরকারের জবাবদিহি বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মসিউর রহমান বলেন, শুল্কমুক্ত থাকলেও ২০১৫ সাল থেকে এ শিল্পে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ খাতকে শুল্কমুক্ত রাখার আহ্বান জানান তিনি।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ ড. নীতীশ দেবনাথ বলেন, দেশে বর্তমানে যে পরিমাণে প্রাণিজ সম্পদ উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে আগামী ১০ বছর চলবে না। আর এ ধরনের খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর যে প্রক্রিয়া তা অন্য খাদ্য থেকে জটিল। এ ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বেশি প্রয়োজন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. কামরুজ্জামান বলেন, মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ যে গতিতে বাড়ছে এবং যে জনবল আছে তা দিয়ে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন। এ খাতের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার বিষয়টিতেও তিনি গুরুত্ব দেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চিকিৎসক মো. আইনুল হক বলেন, মেধাবী জাতি গঠনে এ খাতটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এসডিজির বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক তালুকদার নূরুন্নাহার বলেন, বাংলাদেশকে মধ্যম আয় ও উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে প্রথম প্রয়োজন মেধা। এ ক্ষেত্রে প্রাণিজ আমিষের বিকল্প নেই। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে এ খাতে জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, শুষ্ক মৌসুমে গবাদিপশুর খাদ্যের অভাব, গরুসহ বিভিন্ন গবাদিপশুর দেশীয় জাত সংরক্ষণ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের মতো চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক পশুখাদ্যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে মানবজীবনে কীভাবে হুমকি তৈরি করছে তা তুলে ধরেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক নাজমা শাহীন বলেন, দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রতি ৩ জনের ১ জনের বয়স অনুযায়ী উচ্চতা কম। কিশোরীরা রক্তস্বল্পতা, ফলিক অ্যাসিডের স্বল্পতায় ভুগছে। এ ছাড়া যাদের প্রাণিজ খাদ্য প্রয়োজন তারা তা কিনতে পারছে না।

রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গবাদিপশুর রোগ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন হতে হবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি অ্যানথ্রাক্স সম্পর্কে বলেন, এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচিকে জোরদার করতে হবে।

ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের সভাপতি শামসুল আরেফীন বলেন, কোনো বাড়িতে পোলট্রি খামার থাকলে ওই পরিবারের মাসিক আয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এ শিল্পের উন্নয়নে নিরাপত্তা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা জরুরি।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল চিকিৎসক মনজুর মোরশেদ খান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিকে নজর বাড়ানো, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ল্যাবরেটরি সম্প্রসারণ, গবাদিপশুর গোবর, বিষ্ঠাকে সম্পদে পরিণত করা এবং প্রাণিজ সম্পদকে ‘অ্যানিমেল এগ্রিকালচার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তৌফিকুল ইসলাম খান বাজার ব্যবস্থাপনা এবং ভ্যালু চেইনের সঙ্গে ক্ষুদ্র চাষিদের সম্পৃক্ত করা, গবাদিপশুর জন্য ক্লাস্টারভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন।

দ্য একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের অতিরিক্ত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসিবুর রহমান বলেন, মোট মাংসের চাহিদার মধ্যে ৫২ শতাংশ পূরণ করছে লাল মাংস (রেড মিট)। এই খাতের অপার সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি আছে অপরিসীম সমস্যা। এ খাতের লাগসই ও টেকসই উন্নয়নে সরকারকে বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে হবে।

বেসরকারি সংগঠন সজাগের পরিচালক আবদুল মতিন বলেন, ১ থেকে ৫টি গরুর খামারিদের কাছ থেকে ৯০ ভাগ দুধ পাওয়া যাচ্ছে। এই খামারিদের প্রশিক্ষণ ও সম্মানিত করতে হবে। একেক উপজেলায় গরু ও ছাগলের সংখ্যা লক্ষাধিক, অথচ উপজেলায় সরকারের জনবল আছে চার থেকে পাঁচজন। এ অবস্থার উত্তরণ প্রয়োজন।