ভোলায় প্রতি পাঁচ দিনে একটি ধর্ষণ মামলা

♦ এক বছরে হত্যা মামলা ৩০

♦ নারী হত্যা মামলা ১৫

♦ অপমৃত্যু মামলা ৭০টি

২০১৭ সালে ভোলায় প্রতি পাঁচ দিনের মাথায় একটি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি আট ঘণ্টায় একটি নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে। ওই বছর হত্যা মামলা হয়েছে ৩০টি। নিহত ৩০ জনের মধ্যে ১৫ জনই নারী। অপমৃত্যু মামলা হয়েছে ৭০টি, যার অধিকাংশই পারিবারিক কলহের শিকার।

গেল বছরের মতো চলতি বছরের শুরুতেও নারী নির্যাতনের একাধিক খবর পাওয়া গেছে। জানুয়ারি মাসে প্রায় ২০টি নারী নির্যাতনের খবর পাওয়া গেছে। যার মধ্যে একটি হত্যা ও তিনটি আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে। এসব তথ্য আদালত, প্রশাসন ও থানা সূত্রের।

মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে থানায় ৭০টি ধর্ষণ মামলা, ১৬৪টি নারী নির্যাতন মামলা, ৩০টি হত্যা মামলা ও ৭০টি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। আদালতের তথ্যমতে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০১৬ সাল শেষে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮৮২টি। ২০১৭ সালে ১ হাজার ৫৫টি মামলা হয়েছে। গেল বছর নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬৭টি মামলা। অতিরিক্ত জজ আদালতে বদলিহয়েছে ৪৬২টি মামলা। বর্তমানে ৩ হাজার ২৪৭টি মামলা চলমান রয়েছে। ২০১৭ সালে নারী নির্যাতনের কারণে হত্যা মামলা হয়েছে ১৫টি।

ভোলার কমপক্ষে ২৫ জন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলার প্রতি ইউনিয়নে মাসে কমপক্ষে ২০০-২৫০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ৮০ শতাংশ মামলায় ইউপির চেয়ারম্যান-সদস্যরা সমঝোতা করার চেষ্টা করেন; যার মধ্যে ধর্ষণ মামলাও রয়েছে। আদালত ও থানায় ২০ শতাংশ ঘটনায় মামলা হয়।

জনপ্রতিনিধি ও সালিসকারীদের ভাষ্য, শিশুরা ১০-১১ বছর বয়সে মুঠোফোনে ইন্টারনেটে এমন কিছুর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, যা তার হওয়ার কথা না। এ পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে শিশুকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ও ইভ টিজিংয়ের কারণে মেয়েশিশুরা প্রতারণার শিকার হয়। অসময়ে ছেলেমেয়ের প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে। একপর্যায়ে ছেলেটি সরে গেলে মেয়েটি ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করছে। গ্রাম্য সালিস ও জনপ্রতিনিধিরা এ ধরনের ঘটনা পেলে বিয়ে পড়িয়ে দেন।

জনপ্রতিনিধিরা আরও জানান, জোরপূর্বক ধর্ষণের ঘটনায় মামলা কমই হয়, এটি পরিবার চেপে যায়, নইলে গোপন সালিসে জরিমানা করে ছেড়ে দেন জনপ্রতিনিধিরা।

ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ইয়ানুর রহমান বলেন, মুঠোফোন ও ইভ টিজিংয়ের কারণে মা–বাবার কাছে ১০-১২ বছরের পরে মেয়ে অনিরাপদ হয়ে পড়ে। ফলে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হয়। নানা কারণে এসব বিয়ে টেকে না।

ইয়ানুর রহমান আরও বলেন, তিনি ও তাঁর পরিষদ প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩০টি এ রকম পারিবারিক কলহ, নারী নির্যাতনের ঘটনার সালিস করে। স্বামীরা অনৈতিক সম্পর্ক, জুয়া ও নেশায় টাকা নষ্ট করায় সংসারে কলহ সৃষ্টি হয়। স্ত্রীর ওপর নির্যাতন তখনই শুরু হয়।

ভোলা জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ভোলার বেশির ভাগ মানুষ জেলে এবং খেটে খাওয়া শ্রমিক। তারা স্বাবলম্বী না হয়ে নাবালক অবস্থায় যৌতুক নিয়ে বিয়ে করছে। মেয়ের বাবাও মেয়েকে লেখাপড়া না শিখিয়ে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। প্রথম দু-এক বছর সংসার ভালোই চলে, যখনই স্বামীর পকেটে টান পড়ে, তখনই সংসারে কলহ সৃষ্টি হয়। সেই কলহ থেকে নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যাসহ নানা রকম ঘটনার সৃষ্টি হয়।

ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, মুঠোফোন-ইন্টারনেট ও ইভ টিজিংয়ের কারণে বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ বাড়ছে, এটা সত্য। তবে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জাতীয় পর্যায় থেকে। ইন্টারনেটে ফিল্টারিং করতে হবে। কোন কোন বিষয় ইন্টারনেটে থাকবে, কোন বিষয় থাকবে না, তা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। লেখাপড়ার মান অবনতির কারণও এ অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট।

মোহাং সেলিম উদ্দিন আরও বলেন, জনসচেতনতা ও শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যেসব কমিটি আছে, সেগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। কারণ, ধর্ষণের আগেও ধর্ষণের আলামত ইভ টিজিং হচ্ছে। সমাজসংস্কারকেরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বখাটেরা ভয় পাবে। বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং ও নারী নির্যাতন বন্ধে এবং সুশিক্ষিত জাতি গড়তে বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ খুবই জরুরি।