বাল্যবিবাহে ভন্ডুল ৫১৬৯ ছাত্রীর পরীক্ষা

শুধু বাল্যবিবাহের কারণে গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে ৫ হাজার ১৬৯ জন ছাত্রী জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা দিতে পারেনি। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগ শীর্ষে, সেখানে মোট ১ হাজার ৭০০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। খুলনা বিভাগে এই সংখ্যা ১ হাজার ১৫৬। 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৮টি বিভাগে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় মোট অংশ নেয় ১৩ লাখ ৬৪ হাজার ১৩৪ ছাত্রী। এদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অনুপস্থিত ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ২৬১।
সরকারের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ওই বছর পাঁচ হাজারের বেশি ছাত্রী শুধু বাল্যবিবাহের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ইউনিটের পরিচালক ইসমত মাহমুদা প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহের সার্বিক চিত্র বোঝার জন্য গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে কত শিক্ষার্থী শুধু বাল্যবিবাহের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি, সে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়গুলো বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত এই তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটে পাঠানো হয়, এই ইউনিট বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ইনোভেশন ইউনিট সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কেননা, তারা বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে, যা আগে কখনোই করা হয়নি। এটি সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর মতে, স্কুল থেকে মেয়েরা বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়লেও অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা রাশেদা বলেন, যারা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে, তারা যাতে শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ে, অপ্রাপ্ত বয়সে মা না হয়, সে জন্য পরিবারের সচেতনতা জরুরি। এ জন্য সরকারকেও সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
জেলাভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে করা ওই প্রতিবেদন বলছে, খুলনা বিভাগের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় বাল্যবিবাহের শিকার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৮। সাতক্ষীরা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কয়লা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবদুর রউফ টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এক বছরে বিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন শ্রেণির মোট ২০ জন ছাত্রী বাল্যবিবাহের কারণে ঝরে গেছে। তারা নিজেদের অবস্থান থেকে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, যদিও কাজটি বেশ দুরূহ।
ওই বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সাত ছাত্রীর বিয়ে হয়। একজন শিক্ষার্থী জেএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পরও তার অভিভাবক বিয়ে দেন। তাঁর মতে, আগের চেয়ে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কিছুটা কমলেও তা বন্ধ হয়নি।
১৯২৯ সালের আইনকে যুগোপযোগী করে গত বছর সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। বর্তমানে আইনের বিধি এবং কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গাল৴ সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিবাহকে শূন্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেন।
বাংলাদেশসহ এশিয়ার ১০টি দেশে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা টেরেডেস হোমস নেদারল্যান্ডস। বাংলাদেশে ৩ বছর ধরে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হওয়া মেয়ে, তাদের স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে সচেতন করার কাজ করছে সংস্থাটি। নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ছয়টি ইউনিয়নের সাড়ে আট হাজার মেয়ে এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে।
টেরেডেস হোমস নেদারল্যান্ডসের দেশীয় পরিচালক মাহমুদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, একবার বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন কাজ, বিশেষ করে অন্য এলাকায় বিয়ে হলে। এই মেয়েদের বিয়ের পরই সন্তান নেওয়ার জন্য চাপে থাকতে হয়।
বাল্যবিবাহ চলছেই
নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে এক কিশোরী গতকাল শুক্রবার বিয়ে থেকে রক্ষা পেয়েছে। রায়গঞ্জের ধানগড়া ইউনিয়নের একটি গ্রামের এক স্কুলছাত্রীর বিয়ে গতকাল হওয়ার কথা ছিল। লোকজন ও আত্মীয়দের উপস্থিতিতে কনের বাড়ি দুপুরে ছিল ভরা। বাল্যবিবাহ আয়োজনের খবর রায়গঞ্জের ইউএনওর কাছে জানান কয়েকজন। তিনি মেয়ের উপযুক্ত বয়স (১৮ বছর) না হওয়ায় বিয়ে না দেওয়ার জন্য কনেপক্ষ ও বরপক্ষের অভিভাবকদের বোঝান। ইউএনও ইকবাল আখতার বলেন, স্থানীয় লোকজন এভাবে বাল্যবিবাহ আয়োজনের খবর জানালে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের এক মহল্লায় দুপুরে এক কিশোরীর (১৬) বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় কর্মকর্তা ও পুলিশ কনের বাড়িতে গিয়ে বোঝালে ওই বিয়ে বন্ধ হয়।