বাংলাদেশের মানুষের চোখে আন্তরিকতা

ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে নরওয়ের সাংবাদিক কারি আরসতাদ অসেহ। ছবি: কবির হোসেন
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে নরওয়ের সাংবাদিক কারি আরসতাদ অসেহ। ছবি: কবির হোসেন

কারি আরসতাদ অসেহ একজন সাংবাদিক। নরওয়ের ভিজি পত্রিকার এই আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ১৭ জানুয়ারি তিনি ঘুরে দেখেছেন ঢাকার কারওয়ান বাজার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, চারুকলা অনুষদ...। তাঁর ভ্রমণসঙ্গী আমরা। কথা ছিল পুরো দিন আমরা শুধু ঘুরব। কারির সাক্ষাৎকার নেব পরদিন। কিন্তু গাড়িতে বসেই সাক্ষাৎকার পর্বটা সেরে ফেলার সুযোগ করে দিল ঢাকার যানজট।

১৯৮২ সাল থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত কারি। তাঁর স্বামী তোরি পেদেরসেনও একজন সাংবাদিক, তিনি নরওয়ের ‘শিবস্তেদ মিডিয়ার’ সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। আলাপে বসে নানা অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন দুই সন্তানের মা কারি আরসতাদ অসেহ। কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ভুটান, সিয়েরা লিওন—বহু দেশে তাঁর পা পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা মাথায় এল, ‘কয়টা দেশে গিয়েছেন আপনি?’ একটু ভেবে বললেন, ‘কখনো তো হিসাব করিনি। আমার বাবা এয়ারলাইনসে চাকরি করতেন। তাই কম টাকায় টিকিট পেতাম। ১৪ বছর বয়স থেকে একাই নানা দেশ ঘুরতে শুরু করেছি।’ বেড়াতে ভালোবাসেন বলে হিসাব রাখাটা কখনো তাঁর কাছে গুরুত্ব পায়নি। সাংবাদিকতাও তিনি ভালোবেসে করেন। তাই পেশাজীবনের অর্জন, পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব তাঁর কাছে গৌণ। ইউনিভার্সিটি অব অসলো থেকে রাজনীতি, অপরাধ ও সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন। সাংবাদিকতার ইচ্ছা তখন ছিল না। দাপ্তরিক কাজের জন্য ভিজিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এতটাই আনন্দ নিয়ে তিনি লেখেন, প্রথমবার বেতন পেয়ে নাকি অবাক হয়ে ভেবেছিলেন, ‘লেখালেখি করলে আবার টাকাও দেওয়া হয়!’

কারওয়ান বাজারে
কারওয়ান বাজারে

আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক হিসেবে খুব কাছ থেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছে কারির। বিল ক্লিনটন যেদিন হিলারি ক্লিনটনের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে শুরু করেছেন, সেদিনের একটা অভিজ্ঞতার কথা বললেন। ‘সাংবাদিকদের কাউকে তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছিল না। সাধারণ মানুষের ভিড়ের সঙ্গে মিশে আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আর কী আশ্চর্য, এত লোকের ভিড়ে ক্লিনটন আমার দিকেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তাঁর হাত ধরে আছি, অথচ মাথায় কিছুই আসছিল না। মনে মনে নিজেকে ধমক দিয়ে বললাম, “তুমি একজন সাংবাদিক, একটা কিছু তো বলো!” শেষে একটা প্রশ্নই করতে পেরেছিলাম—স্ত্রীর হয়ে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছ, কেমন লাগছে?’ সেদিন ক্লিনটন বলেছিলেন, ‘এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।’ পরদিন ক্লিনটনের বক্তব্যটাই শিরোনাম করেছিলেন কারি।

প্রেসিডেন্ট, শিল্পপতি, রকস্টার থেকে শুরু করে ঘরহীন মানুষের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন এই সাংবাদিক। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। একটি ঘটনা তাঁর এখনো মনে পড়ে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে জাপানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নরওয়ে থেকে ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছেন কারি। তখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। কারিকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সংবাদ সংগ্রহ করতে দেখে তাঁর দিকে ছাতা এগিয়ে দিয়েছিলেন ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী। কারি বলছিলেন, ‘ভাবতে পারেন? একজন মানুষ তাঁর পুরো সংসারটা দুটো ব্যাগে ভরে রাস্তায় নেমে এসেছেন। সেই ব্যাগ থেকে বের করে তিনি আমাকে একটা ছাতা দিয়েছেন!’

একজন সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ
একজন সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ

সিয়েরা লিওনেও মানুষের মানবেতর জীবন দেখেছেন তিনি। ইবোলা ভাইরাস যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ল, দুই সপ্তাহ ধরে ঘটনাস্থলের আনাচকানাচে ঘুরেছেন। কাউকে ছোঁয়া যাবে না, কোনো কিছু ধরা যাবে না, অথচ নিজের কাজটা করতে হবে—প্রতিবেদন তৈরি করা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল তাঁর জন্য। কারি বলছিলেন, ‘একটা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে শুরুতেই আমরা হাত বাড়িয়ে দিই। অথচ সিয়েরা লিওনে কারও সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগেই মাথায় রাখতে হতো—হাত বাড়ানো যাবে না। এমনকি কাজ শেষে গাড়িতে ওঠার আগে আমাদের জুতার তলায়ও ক্লোরিন স্প্রে করতে হতো।’

সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সব অভিজ্ঞতাই যে কঠিন, চ্যালেঞ্জিং, তা নয়। কিছু কিছু দেশ তাঁকে স্নিগ্ধ অনুভূতিও দিয়েছে। যতগুলো দেশ ঘোরা হয়েছে, তার মধ্যে কারিকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে ভুটান। তাঁর ভাষ্য, ‘এত ছোট একটা দেশ। ধনসম্পদ তেমন নেই। কিন্তু সেখানকার মানুষ দেখলে মনে হয়, তারা সুখে আছে। আমি অনেক ধনবান দেশে দেখেছি, মানুষের মনে সুখ নেই। ভুটান গিয়েছিলাম প্রায় ১০ বছর আগে, এখনো আমার ভুটান ভ্রমণের কথা মনে পড়ে। দেশটা আমার মনোজগতে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে

এই যে এত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, কথা হয়, জানার সুযোগ হয়, কারির কাছে সাংবাদিকতার আনন্দ এটাই। তিনি মনে করেন, একজন সাংবাদিককে সব সময় কৌতূহলী হতে হয়। কারির সঙ্গে বেড়ানোর সময়ই অবশ্য তাঁর কৌতূহলী চরিত্রের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। চিকন চাল আর মোটা চালের মধ্যে পার্থক্য কী, রাস্তায় যে লোকটার পোস্টার সাঁটানো তিনি কে...পথ চলতে চলতে এমন অনেক প্রশ্ন করছিলেন তিনি। উত্তর দিতে হচ্ছিল আমাদের।

কারওয়ান বাজার ঘোরাঘুরি শেষে বেশ উচ্ছ্বসিত মনে হলো তাঁকে; বিশেষ করে মাছের বাজার। এত রকম মাছ, তার ওপর অনেক মাছই রীতিমতো পানিতে লাফঝাঁপ দিচ্ছে, এই দৃশ্য কারির চোখে নতুন। খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি ছবি তুলছিলেন। প্রতিবারই ছবি তোলার আগে বিক্রেতার কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছিলেন, ‘মে আই টেক আ ফটো?’ (আমি কি একটা ছবি তুলতে পারি?)। কারির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ফিরে গিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে যদি কিছু লেখেন, লেখার বিষয় কী হতে পারে?’ বললেন, ‘আশপাশটা খুব রঙিন। এই রং নিয়ে একটা ফটোফিচার হতে পারে।’

ঘুরে দেখেছেন কার্জন হল
ঘুরে দেখেছেন কার্জন হল

একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে কারি জানেন, বিশ্বের কিছু কিছু দেশে নারীদের জন্য কাজের পরিবেশ খুব একটা অনুকূল নয়। বাংলাদেশে আসার আগে যে এ দেশ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা পোষণ করতেন না, সে কথাও স্বীকার করলেন। ঘোরাঘুরি শেষে ধারণা কী বদলে গেল? অভিজ্ঞ সাংবাদিক কারি আরসতাদ অসেহ উত্তর দিলেন বেশ বিচক্ষণতার সঙ্গে, ‘আমি তো এ দেশে খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছি। ঢাকার বাইরে কিছু দেখা হয়নি। তবে একটা ব্যাপার বলতে পারি। অনেক দেশেই দেখেছি, বিদেশি দেখলে মানুষ তাকিয়ে থাকে। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ভারত, পাকিস্তানের মতো কিছু কিছু দেশে মানুষের চাহনী দেখে আমি অনিরাপদ বোধ করেছি। বাংলাদেশে সেটা হয়নি। এখানকার মানুষও তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তাঁদের চোখে কৌতূহল আর আন্তরিকতা ছাড়া কিছু পাইনি।’