সুন্দরীগাছ কমছে সুন্দরবনে

* ২৫ বছরে কমেছে প্রায় ৫৪ হাজার হেক্টরের সমান।
* ফাঁকা জায়গায় চট্টগ্রামের মতো তিনটি শহর ঢোকানো যাবে।
* সুন্দরবনের ভেতরে ঘন বনের পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ।
* গাছের পরিমাণ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা।
* সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

সুন্দরবনের প্রধান সম্পদ সুন্দরীগাছ কমছে। গত ২৫ বছরে সুন্দরীগাছ যে পরিমাণ কমেছে, তা প্রায় ৫৪ হাজার হেক্টরের সমান হবে। সহজ করে বললে, গাছ কমে বনে যে পরিমাণ ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছে, তার ভেতরে চট্টগ্রামের (১৫৫ বর্গ কিলোমিটার বা ১৫ হাজার ৫০০ হেক্টর) মতো তিনটি বড় শহর অনায়াসে ঢোকানো যাবে। গাছ কমতে থাকায় সুন্দরবনের ভেতরে ঘন বনের পরিমাণ গত ২৫ বছরে কমেছে ২৫ শতাংশ। এতে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, অবাধে ইঞ্জিনচালিত নৌযানের চলাচল, গোলপাতা সংগ্রহসহ বিভিন্ন সম্পদ আহরণের কারণে ভবিষ্যতে সুন্দরবনে গাছের পরিমাণ এবং বনের ঘনত্ব আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ১৯৮৯ সালে সুন্দরীগাছ বনের ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জুড়ে ছিল। ২০১৪ সালে তা কমে গিয়ে ১ লাখ ১২ হাজার ৯৯৫ হেক্টর হয়।

বনের ঘনত্ব ও গাছপালার পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য গবেষকেরা ১৯৮৯ সাল থেকে পাওয়া সুন্দরবনের স্যাটেলাইট ইমেজ (উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি) বিশ্লেষণ করেন। এতে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনে ঘন বনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা হয় ৩৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ঘন বনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনে হালকা বনের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ঘন বনের ক্ষেত্রে বৃক্ষ আচ্ছাদনের পরিমাণ ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ এবং সূর্যের আলো বৃক্ষ আচ্ছাদন ভেদ করে মাটিতে তেমনভাবে আসতে পারে না। কোনো বনের বৃক্ষ আচ্ছাদনের পরিমাণ ৫০ শতাংশের নিচে নেমে এলে সেটি হালকা বনে রূপ নেয়। গবেষকেরা জানান, ঘন বন থাকলে ভূমি ক্ষয় হয় না। ঘন বনের মধ্যে পশু-পাখির বসবাস নিরাপদ।

সুন্দরবনে ঘন বন কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরীগাছ মূলত বনের ভেতরে মিঠাপানির এলাকায় বেশি হয়। কিন্তু বনে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। এই বন থেকে যত গাছ চুরি হয়, তার মধ্যে এই গাছই বেশি। এভাবে চলতে থাকলে সুন্দরবনের মূল বৈশিষ্ট ও জীববৈচিত্র্য বদলে যাবে। সুন্দরীগাছ রক্ষায় বন বিভাগকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।

 যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট সুন্দরবন নিয়ে এই গবেষণাটি করে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএসএইড এবং জন ডি রকফেলার ফাউন্ডেশন এতে আর্থিক সহায়তা দেয় বলে জানান উইনরক ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শাহজীয়া মহসিন খান। গবেষণার শিরোনাম ‘সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’।

সুন্দরবন নিয়ে করা আন্তর্জাতিক এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এ এইচ এম রায়হান সরকার। গবেষক দলে ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নূর নবী ও আইইউসিএন বাংলাদেশের জিআইএস অ্যানালিস্ট ইমরান হাসান। গবেষণায় সহায়তা করেন স্পারসোর (মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মেহেরুন নেসা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া এই গবেষণা তিন বছর পর গত সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হয়।

 সুন্দরবন রক্ষায় ২০ বছর আগে জ্বালানি কাঠ ও চিংড়ি পোনা সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বন বিভাগ। কিন্তু গবেষণার সময় গবেষকেরা দেখেছেন এই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।

এ বিষয়ে বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, বনের ঘনত্ব বাড়াতে কাজ করছে বন বিভাগ। সুন্দরবন থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ ও যেকোনো ধরনের কাঠ সংগ্রহ এখন নিষিদ্ধ।

১৯৮৯ সালে সুন্দরবনে জলাধার (নদী-খাল ইত্যাদি) ছিল ২৯ শতাংশ এবং খালি ভূমির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৬০ শতাংশ। ঘন বন কমার কারণে খালি ভূমি এবং নদীভাঙনের কারণে জলাধারের পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৪ সালে সুন্দরবনে জলাধারের পরিমাণ বেড়ে হয় ৩২ শতাংশ এবং খালি ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ শতাংশে।

জনশ্রুতি হচ্ছে, সুন্দরীগাছ থেকেই সুন্দরবনের নাম এসেছে। মাঝারি গড়নের চিরসবুজ গাছ সুন্দরী। এর বাকল কালচে ধূসর বা বাদামি। উচ্চতায় সাধারণত ১৫ থেকে ১৯ মিটার। পাতা একান্তর, চিরসবুজ। মধ্যশিরা স্পষ্ট। সুন্দরবনের সাধারণত কম লবণাক্ত এলাকার মাটিতে এটি ভালো জন্মে।

গবেষণা দলের প্রধান রায়হান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরীগাছ কমে যাওয়ার কারণ আগা মরা রোগ। এ ছাড়া লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এই গাছ কমে যাচ্ছে। সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ে অনেক গাছ ধ্বংস হয়েছে। এ ছাড়া গাছ চুরিও হচ্ছে। বনের ঘনত্ব কমার বিষয়টি স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন।

সুন্দরীগাছের পর গেওয়াগাছও দিনে দিনে কমছে। ১৯৮৯ সালে বনের ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৭৭ হেক্টর জুড়ে এই গাছ ছিল। ২০১৪ সালে তা প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৭৪ হাজার ১৭০ হেক্টরে নেমে আসে।

সুন্দরবন রক্ষায় পর্যটক সীমিত করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলেন, পর্যটকদের বেশি আনাগোনা, জাহাজ চলাচলসহ নানা কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে।

এই গবেষণায় ৬ লাখ ৩ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবনের মূল চারটি খাতের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়, যার পরিমাণ ৭০ কোটি ২১ লাখ ডলার বা ৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা (ডলারপ্রতি ৭৮ টাকা হিসেবে)। ইকোট্যুরিজম, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুরক্ষা, আহরিত সম্পদ এবং কার্বন মজুত (গাছপালা-লতাগুল্মের এবং মাটি, জৈব উপাদানের যে পরিমাণ কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা তার আর্থিক মূল্য) হিসাবের মাধ্যমে আর্থিক পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করার পাশাপাশি চিংড়ি চাষ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয় গবেষণায়। এ ছাড়া জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেছেন গবেষকেরা।