আগামীর রাজশাহী
রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট। সারা দিন যানবাহনে ঠাসা। পাশেই বড় মসজিদ চত্বর। দালানের চিপায় মানুষের ভিড়। ঐতিহ্যবাহী সোনাদিঘির মুখ দেখারই জো নেই। চিপাগলির ভেতরে ধুঁকছে ১৩৯ বছর বয়সী রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাগুলোতে এখনই মানুষের দম আটকে আসে। ভাবলে গা শিউরে ওঠে ৩০ বছর পর কেমন হবে এই প্রিয় শহর। এই ভাবনা থেকে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের রাজশাহীর নকশা তৈরি করেছেন।
গত ৩ জানুয়ারি তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রদর্শনীতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে পরিকল্পিত রাজশাহী নগরের সেই ছবি দেখিয়েছেন। সেই নকশার ত্রিমাত্রিক মডেলও তৈরি করেছেন। দিনব্যাপী এসব ছিল দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। দর্শনার্থীরা এগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন।
রুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ‘আরবান ডিজাইন স্টুডিও’তে পাঠক্রমের প্রকল্প হিসেবে এই নকশা প্রণয়ন করেছেন। বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ও প্রভাষক জেড এইচ এম মঞ্জুর মোর্শেদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা এই প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন।
শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের নগরায়ণের এই পরিকল্পনাকে চারটি ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করেছেন। এগুলো হচ্ছে, ‘ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট’, ‘প্লেস মেকিং’, ‘নেইবারহুড ডিজাইন’ ও ‘ইকোলোজিক্যাল আরবানিজম’।
রাজশাহী নগরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট ও রেলগেট এলাকায় ‘ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট’ নকশা তৈরি করেছে। নগরের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া যানজট কমানোর জন্য ভবিষ্যতে শহরজুড়ে গণপরিবহনের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে।
রাজশাহী নগরের বড় মসজিদ চত্বর, সোনাদিঘির মোড় ও বরেন্দ্র জাদুঘরের মোড়কে তাঁরা ‘প্লেস মেকিং’-এর আওতায় এনে নকশা তৈরি করেছেন। শহরের এই জায়গাগুলোতে প্রতিদিন ব্যাপক জনসমাগম হয়। নকশা অনুযায়ী এই জায়গাগুলোতে মানুষ বেড়াতে পারবেন। তাঁদের জন্য থাকবে মিনি পার্ক, খাবারের দোকান, বসার জায়গা ও লাইব্রেরি।
বাংলাদেশের পুরোনো শহরগুলোর মধ্যে রাজশাহী একটি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে মূল শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ ও খেলাধুলার জায়গার সংকট রয়েছে। ‘নেইবারহুড ডিজাইন’-এর মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের প্রস্তাবিত নকশায় সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
রাজশাহী ইতিমধ্যে গ্রিন সিটি হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজশাহী পুকুরের শহর হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল। ৫০ বছর আগেও এই শহরে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পুকুর ছিল। বর্তমানে তা প্রায় ২৫০টিতে এসে ঠেকেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই শহরের অন্যতম একটি সমস্যা। এই ধারাবাহিকতায় সবুজায়ন ও পানি ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে শহরের উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। এই নকশার আওতায় জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একটি পার্ক নগরের বর্তমান শিমলা পার্কের জায়গায় প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রদর্শনীতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক নকশা বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন।
রুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ইকবাল মতিন বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে যা শিখছে তা আগামীতে নগরায়ণের ক্ষেত্রে মানুষকে যাতে স্বপ্ন দেখাতে পারে, এ জন্য তারা তাদের এই প্রদর্শনীতে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী ও রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদকে রেখেছিলেন। অনুষ্ঠানে এসে তাঁরা শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করেছেন। শিক্ষার্থীদের কাজের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের এই সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করেছেন।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, যদিও এটা ছাত্রছাত্রীদের কাজ, তবু তাঁদের ভাবনা পরিকল্পিত নগরায়ণে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাতে সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত রয়েছে।