৩১ হাজার নবজাতকের মৃত্যু প্রথম দিনেই

প্রথম আলো আয়োজিত ‘প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাঁর পাশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ‘প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাঁর পাশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। ছবি: প্রথম আলো

অপরিণত জন্ম, জন্মের সময় নানান সমস্যা ও সংক্রমণের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬২ হাজার নবজাতক (জন্ম থেকে ২৮ দিন) মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে জন্মের পর এক দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৫০ শতাংশ (৩১ হাজার) নবজাতক। নবজাতক মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই ঘটছে সংক্রমণ, শ্বাসজনিত সমস্যা ও স্বল্প ওজন নিয়ে অপরিণত জন্মসংক্রান্ত কারণে। অথচ এই কারণগুলো প্রতিরোধযোগ্য।

আজ মঙ্গলবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের মূল বক্তব্যে এ তথ্যগুলো জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট শিশু বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি বলেন, জন্মের পর ৭ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ১৯ শতাংশ নবজাতক। নবজাতকের মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটছে বাড়িতে। পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর ৬০ শতাংশই হচ্ছে নবজাতকের মৃত্যু। কিশোরী মাতৃত্বের কারণে নবজাতকদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফের সহযোগিতায় কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আলোচকেরা জানান, নবজাতকের শরীর মুছিয়ে দেওয়া, দেরিতে গোসল করানো, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, স্বল্প ওজন ও অপরিণত জন্ম নেওয়া নবজাতককে মায়ের দুই স্তনের মাঝখানে ত্বকের সঙ্গে রাখা (ক্যাঙারু মাদার কেয়ার), নাভিতে সংক্রমণ এড়ানো, শ্বাসজনিত সমস্যায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াসহ বিশেষ কিছু বিষয়ের দিকে নজর দিলেই নবজাতকদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসব এবং গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নবজাতককে গণনায় আনতে হবে।

‘প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্য বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো
‘প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্য বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কিশোরী মাতৃত্ব কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই মায়েদের সন্তান স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর নবজাতক মৃত্যুর ৪৫ শতাংশই ঘটছে এ কারণে। নবজাতক মৃত্যু রোধে মায়েদের সচেতনতা ও ক্ষমতায়ন জরুরি। সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহর এবং ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে যে বৈষম্য, তা দূর করতে পারলেও নবজাতক মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। বাড়িতে প্রসবের সংখ্যা কমাতে পারলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে জনবল–স্বল্পতা, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব, বাজেট–স্বল্পতা, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাব, মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত না হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা আছে। এসব সমস্যা দূর করতে সরকারি, বেসরকারি ও দাতাগোষ্ঠীর কাজের সমন্বয়ের প্রয়োজন। তিনি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি নির্বাচনী ইশতেহারে নবজাতক মৃত্যুর হার কমানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।

গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বাড়িতে প্রসবের পর ৫৫ শতাংশ মাতৃমৃত্যু এবং নবজাতক মৃত্যুর ৭৩ শতাংশ ঘটছে। বর্তমানে তিন হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকার ৬৫ হাজার মাল্টিপারপাস হেলথ ভলানটিয়ার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নবজাতক খাতে সরাসরি ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দসহ বিভিন্ন খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত। বাজেটের যথাযথ ব্যবহার, পেশাজীবীদের সেবার মনোভাব, সরকারি ও বেসরকারি কাজের মধ্যে সমন্বয় এবং মানুষ সচেতন হলে নবজাতকের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এম এ কে আজাদ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান এম এ মান্নান, ইউনিসেফের হেলথ ম্যানেজার জিয়াউল মতিন, ইউনিসেফের চিফ হেলথ মায়া ভেনদানেন্ট, সরকারের প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের পরিচালক খালেদা ইসলাম, পেশাজীবী সংগঠন অবসট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সেক্রেটারি জেনারেল ফিরোজা বেগম, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের (নিউবর্ন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ) এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফরিদ উদ্দিন আহমদ, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের টেকনিক্যাল অফিসার আবু সাঈদ মো. হাসান, সেভ দ্য চিলড্রেনের নিউবর্ন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ মামণি এইচএসএস প্রজেক্টের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সাব্বীর আহমেদ, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের সহকারী বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান, নার্সিংয়ে মিডওয়াফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) জাহেরা খাতুন। গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০টি দেশে ‘এভরি চাইল্ড এলাইভ ক্যাম্পেইন’ পরিচালিত হচ্ছে।