ভারপ্রাপ্তের ভারে পিষ্ট গৌরনদী

>
  • গৌরনদীতে কাজ করতে এসে অনেক চাপের মুখে থাকতে হয়।
  • রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে অনেকে আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
  • কর্মকর্তা এলেও তদবির করে বদলি হয়ে চলে যান।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় ১০টি দপ্তরে প্রধান কর্মকর্তা নেই। এসব দপ্তরে সহকারী অথবা অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এতে উপজেলার স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

ওই ১০টি দপ্তর হলো উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), আনসার-ভিডিপি, পরিসংখ্যান, নির্বাচন, হিসাবরক্ষণ, পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা, সেটেলমেন্ট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।

গত ১৬ জানুয়ারি থেকে এখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও (ইউএনও) ছিলেন না। গত বুধবার এ পদে খালেদা নাছরিন যোগ দেন। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। তাই অন্য কার্যালয়গুলোর কথা জানেন না। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ইউএনওর দপ্তরের সার্টিফিকেট সহকারী (সিএ) আবদুল মজিদ বলেন, এর আগে এখানকার ইউএনও মো. মাসুদ হাসান পাটোয়ারী ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল বদলি হয়ে যান। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শরীফ আহম্মেদ ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ৩০ আগস্ট বদলি হয়ে যান।

এরপর ইউএনও হিসেবে যোগ দেন মাসুমা আক্তার। চার মাসের কিছু বেশি সময় দায়িত্ব পালনের পর তিনি গত ১৬ জানুয়ারি বদলি হয়ে যান। এভাবে এক বছরের মধ্যে এখানে চারজন ইউএনও আসেন-যান। এতে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।

কয়েকজন বিদায়ী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গৌরনদীতে কাজ করতে এসে অনেক চাপের মুখে থাকতে হয়। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে অনেকেই এখানে আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এলেও তদবির করে বদলি হয়ে চলে যান।

গত ৩১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন দপ্তরে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি।

এ সময় কার্যালয়গুলোর সহকারীরা বলেন, কর্মকর্তারা অফিসের কাজে বাইরে রয়েছেন।

তবে সেবা নিতে আসা আজিজুল ইসলাম, সোহেল আহম্মেদ, মমতাজ বেগমসহ কয়েকজন বলেন, এ উপজেলার কোনো দপ্তরেই কর্মকর্তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভারে তাঁরা পিষ্ট হয়ে পড়েছেন। এর চেয়ে অফিসগুলো বন্ধ করে দিলেই ভালো হয়!

গত বছরের ৩০ আগস্ট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শরীফ আহম্মেদ বদলি হন। এরপর থেকে পদটি শূন্য। এ কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ জরিপকারী মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘এসি ল্যান্ড স্যার না থাকায় কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। কার্যালয়ে ২০১৩ সাল থেকে কানুনগোর পদও শূন্য রয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মচারী বলেন, গৌরনদী ভূমি অফিসে বিভিন্ন ‘চাপ’ থাকায় কেউ এখানে এসে থাকতে চান না।

৩১ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় উপজেলা আনসার-ভিডিপি কার্যালয়ে গিয়ে কক্ষ তালাবদ্ধ দেখা যায়। এ সময় মুঠোফোনে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মরিয়ম আক্তার বলেন, উপজেলা আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তা মো. নাজেম আলী গত ৬ জুন অবসরে যান। সেই থেকে পদটি শূন্য।

সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দায়িত্বে থাকলেও বর্তমানে প্রশিক্ষণে রয়েছেন। দপ্তরের অন্য পদগুলো শূন্য থাকায় কার্যালয়টি তালাবদ্ধ রয়েছে। তিনি আগামী মার্চ পর্যন্ত প্রশিক্ষণে থাকবেন।

উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে কক্ষ তালাবদ্ধ দেখা যায়। এ সময় অফিস সহকারী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা আতিকুর রহমান এক বছর দুই মাস আগে পদোন্নতি পেয়ে চলে গেছেন। সেই থেকে পদটি শূন্য। বরিশাল বিভাগের উপপরিচালক স্যার এখানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আছেন। কিন্তু বরিশালে প্রচুর কাজ থাকায় তিনি এখানে আসতে পারেন না।’

উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়েও তালাবদ্ধ দেখা যায়। এ কার্যালয়ের এমএলএসএস মো. ফারুক হোসেন বলেন, নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান গত ডিসেম্বরে বদলি হয়েছেন। বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন আগৈলঝাড়ার নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাইদুর রহমান। তিনি আগৈলঝাড়ায়ই অধিকাংশ সময় অফিস করেন।

এ কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা মাগুরা মাদারীপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন ও বর দুলালী গ্রামের আসিকুর রহমান বলেন, তাঁরা নাম সংশোধনের জন্য বারবার অফিসে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু কর্মকর্তা না থাকায় কাজ না করেই ফিরে যাচ্ছেন।

গৌরনদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম গত ৭ জুন বদলি হন। এ সার্কেলের স্টেনো মো. গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘স্যার যাওয়ার পরে এখানে কেউ যোগ দেননি।

তবে বাকেরগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মফিজুল ইসলাম স্যার ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।’

হত্যা মামলার আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে গৌরনদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলামকে গত ২৬ জানুয়ারি বরিশাল পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এরপর ওসির দায়িত্ব নেন পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আফজাল হোসেন।

উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল বারেক মোল্লা গত ৪ জানুয়ারি পদোন্নতি পেয়ে চলে গেছেন। সেই থেকে মুলাদীর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সুধাংশু কুমার হাওলাদার এখানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে আছেন। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গত ২৪ সেপ্টেম্বর বদলি হয়েছেন।

এরপর থেকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আছেন গৈলা বেবি হোমের উপতত্ত্বাবধায়ক মো. আবুল কালাম। গত ৪ জুলাই উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বদলি হন।

সেই থেকে সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. মাইনুদ্দিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন। উপজেলা সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা মো. জিয়াউল কবির গত ৬ জুন বদলি হন। সেই থেকে সহকারী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা অশোক কুমার দেবনাথ ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আছেন।

সেবা নিতে আসা মো. সাহেব আলী নামের একজন বলেন, ‘কর্মকর্তা না থাকায় আমরা সেবা নিতে এসে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছি।’

জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কার্যালয়গুলোয় দ্রুত কর্মকর্তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।