পুলিশের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন

>

পুলিশ ব্যস্ত অন্য কাজে, ফলে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপকতা মাত্রা ছাড়ালেও তা ঠেকাতে তেমন কোনো তৎপরতা নেই পুলিশের

চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত আট দিনের পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ। আগাম ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপকতা মাত্রা ছাড়ালেও তা ঠেকাতে তেমন কোনো তৎপরতা নেই পুলিশের। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের তৎপরতা আর দক্ষতা নিয়ে।

তবে পুলিশের কার্যালয়গুলো ঘুরে জানা গেছে, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার আর খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড–পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে পুলিশের বড় একটি অংশ ব্যস্ত। প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরতে কোনো কাজ করছে না থানার পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), র‍্যাব বা পুলিশের অন্য ইউনিটগুলো অন্তর্জাল ঘেঁটে প্রশ্ন বেচাবিক্রির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও এখনো উৎসে যেতে পারেনি।

এই ১৪ দিনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ ১৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। র‍্যাব-২ গ্রেপ্তার করেছে আরও দুজনকে। তবে এরা সবাই ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত।

ঢাকার গুলশান বিভাগের একটি থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিভিন্ন সময় দাপ্তরিক যেমন চিঠি পান, তেমনই একাধিক চিঠি পেয়েছেন; যাতে বলা হয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তবে জঙ্গি বা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারে যে রকম নজরদারি ও উদ্যোগ থাকে, এ ক্ষেত্রে তার কিছুই নেই। তাই তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে তেমন তৎপর নন।

আরেক থানার ওসি বলেন, থানাগুলোতে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধের বিষয়ে ‘প্রকৃত’ কোনো নির্দেশনা ওপর থেকে আসেনি। দাপ্তরিক নিয়মিত চিঠি অনেক বিষয়েই আসে। যখন কোনো বিষয় নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন সে বিষয়ে মৌখিকভাবেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

দুই ওসিই বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে তাঁরা কোনো তল্লাশি চালাননি। এটা আসলে বাস্তবে প্রতিপালন করা সম্ভব নয়। কারণ, ঢাকা শহরের ঘিঞ্জি এলাকাগুলোতে কেন্দ্রের সঙ্গে লাগোয়া ঘরবাড়ি, রাস্তা রয়েছে। নির্দেশনা মানতে গেলে এখন রাস্তায় গাড়ি-রিকশা-পথচারী থামিয়ে ‘গণতল্লাশি’ চালাতে হবে। কারণ, কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যেই অনেক বড় রাস্তা, ফুটপাত রয়েছে।

ডিবি উত্তরের তৎপরতা

ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন উপকমিশনার গতকাল বলেন, ডিবি উত্তরের উপকমিশনারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম ‘পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত জাতীয় মনিটরিং কমিটির সদস্য’। তাই তাঁর বিভাগ এ–সংক্রান্ত কাজ করছে বেশি।

শেখ নাজমুল আলম বলেন, অন্তর্জালে হাজারের বেশি গ্রুপ খোলা হয়েছে। এসব যাচাই–বাছাই করে পুলিশের কাজ চলছে। তবে প্রশ্ন ফাঁসের উৎস এখনো জানা যায়নি।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎস জানতে না পারলেও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বেচাকেনার সঙ্গে যুক্তদের ধরতে অন্তর্জালে ফাঁদ পেতে বসেছে পুলিশ।

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নজরদারি করার দায়িত্বে থাকা ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপে হাজারো গ্রুপ খুলে প্রশ্ন বেচাবিক্রি চলছে। এক গ্রুপের কাছ থেকে প্রশ্ন কিনে নিজেরাও আরেকটি গ্রুপ খুলে বেচা শুরু করে দিচ্ছে কেউ কেউ। এভাবে এমএলএম কোম্পানির মতো চলছে বেচাকেনা। তাই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে তা।

ডিবি সূত্র জানায়, ফেসবুক গ্রুপগুলোতে তাঁরাও ক্রেতা সেজে ঢুঁ দিচ্ছেন। প্রশ্নবিক্রেতাদের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে প্রশ্ন কেনা হচ্ছে। এভাবে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা সবাই বলেছেন, অন্য গ্রুপ থেকে প্রশ্ন কিনে তাঁরা বেচেছেন। তাঁদের একজনের কাছে হাতে লেখা গণিতের একটি প্রশ্নও পাওয়া গেছে। যেটি পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হয়েছে বলে ধারণা। সেটিরও উৎস পাওয়া যায়নি।

ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলায়েন বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁরা অন্য গ্রুপ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেছেন। অন্যভাবেও প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত চালানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।

পুলিশের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন

তবে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরতে সরকার ও পুলিশের আন্তরিকতা নেই বলেই সাধারণ মানুষের ধারণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জিয়া রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে সব ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন চলছে। যার কারণে পুরো জীবনব্যবস্থা অস্থির হয়ে উঠেছে, সনাতনি মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজে নতুন নতুন অপরাধ হচ্ছে। আবার এগুলো ঠেকানোর ক্ষেত্রে সরকার বা শিক্ষামন্ত্রী সনাতনি চিন্তা থেকে বের হতে পারছেন না। “প্রশ্ন ফাঁস হয়নি” এ ধরনের বিভ্রান্তিকর উত্তরও তাদের কাছ থেকে শুনছি আমরা।’

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের কারও বিরুদ্ধে ফেসবুকে কিছু লেখা হলে পুলিশ ঠিকই ধরতে পারছে। কিন্তু ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস যারা করছে, তাদেরকে কেন ধরা যাচ্ছে না, সেটি এখনো বোধগম্য নয়।’