৪০ হাজার ভবনের মধ্যে ১৬২টি নিয়ম মেনেছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
  • ভবনে বসবাস বা ব্যবহারের আগে বাধ্যতামূলক সনদ নিচ্ছেন না মালিকেরা
  • নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না তা নজরদারি হচ্ছে না
  • ভবন মালিক নকশায় পরিবর্তন আনলেও তা ধরা পড়ছে না

মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ভবনে বসবাস বা ব্যবহারের আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ব্যবহার বা বসবাস সনদ নিতে হবে। আইন চালুর পর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ১০ বছরে প্রায় ৪০ হাজার ভবন নির্মাণ হয়েছে রাজধানীতে। অথচ মাত্র ১৬২টি ভবন ওই সনদ নিয়েছে।
নগরবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) না নেওয়ায় নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো ভবন মালিক অনিয়ম করে নকশায় পরিবর্তন আনলেও তা ধরা পড়ছে না। ফলে নির্মিত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও তা চিহ্নিত হচ্ছে না। ভবন ব্যবহার সনদ না নিলে রাজউক থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজউক অন্য বিষয়ে যতটা তৎপর, আইন বাস্তবায়ন বা বলবৎ করতে ততটা নয়। ভবনে বসবাসের আগে সনদ নিতে নগরবাসীও চিন্তিত নয়।
২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই ব্যবহার বা বসবাস সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক।
রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখা সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর রাজউক থেকে গড়ে পাঁচ হাজার নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমতি নেওয়ার পরের তিন বছর এই নকশার মেয়াদ থাকে। প্রতিবছর অনুমোদিত নকশার ৮০ শতাংশ ভবন নির্মিত হয়। অথচ মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬২টি ভবন ব্যবহার সনদ নিয়েছে।
রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণের সময় অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটছে। নির্মাণের সময় নকশার চাইতে ডানে-বাঁয়ে এক-দেড় ফুট বাড়িয়ে ফেলছেন কিংবা আট তলার অনুমোদন নিয়ে সাড়ে আট বা নয়তলা বানিয়ে ফেলছেন। নির্মাণ শেষে ব্যবহার সনদ না নেওয়া হলেও এসব ভবন মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
মিরপুর ১ নম্বর এলাকার একজন বাড়ির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজউক থেকে অনুমোদিত নকশায় ভবনের নিচতলার পুরোটা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখার কথা। এক পাশে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রেখে আরেক পাশে বসবাসের জন্য ফ্ল্যাট করা হয়েছে। কিন্তু ভবন নির্মাণের পরে রাজউক থেকে কেউ দেখতেও আসেনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, যদি আইনে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা সংযুক্ত থাকত যে এই ছাড়পত্র ছাড়া ওয়াসা পানির লাইন দেবে না, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হবে না, তাহলে সবাই বাধ্য হতো।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনগুলো পাঁচ বছর পরপর ব্যবহার সনদ নবায়ন করলে রাজউক সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে পারত। বর্তমানে রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবহার সনদ নেওয়ার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য একাধিকবার গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ব্যবহার সনদের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে রাজউকের কাজও অনেকটা কমে আসে। নিরাপদ বসবাসের একটা নিশ্চয়তাও তৈরি হয়। ব্যবহার সনদ ছাড়া কোনো পরিষেবা সংস্থা যেন গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়, তার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত
বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটা অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা কেমন আছে, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ আছে কি না, কাছাকাছি পানির সংস্থান কোথায় আছে, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে অনাপত্তিপত্র দেয়। বসবাস শুরুর আগে অগ্নিনিরাপত্তার কার্যকারিতার সনদ নিতে হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮২২ জন মালিক বা কর্তৃপক্ষ ভবনের নকশা অনুমোদনের প্রাথমিক অনাপত্তিপত্র নিয়েছেন। আর এ সময়ে অগ্নিনিরাপত্তার কার্যকারিতার সনদ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩৩টি ভবনের অনুকূলে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যায় অল্প হলেও কেউ কেউ ভবন নির্মাণ শুরুর আগে অনাপত্তিপত্র নিয়ে থাকেন। কিন্তু ভবন নির্মাণের পর সেখানে বসবাস শুরু করার আগে চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়ার যে বিষয়টি আছে, সেটা কেউ মানেন না।