তাজউদ্দীনের দিনলিপি

• তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫২ সালে ছিলেন ২৬ বছরের তরুণ।
• ১৯৪৬-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দিনলিপি লিখেছেন তাজউদ্দীন আহমদ।
• রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদ দিনলিপি লিখতেন ইংরেজি ভাষায়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি লেখা তাজউদ্দীনের দিনলিপির একটি পৃষ্ঠা
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি লেখা তাজউদ্দীনের দিনলিপির একটি পৃষ্ঠা

প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে ৭টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস ছিল তাজউদ্দীন আহমদের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ঘুম ভেঙেছিল ভোর সাড়ে ৫টায়। ট্রেনে করে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। দুপুরে নেমেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছেই ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে। তারপর যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি পা রেখেছিলেন, সেখানে তখন ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তটি কেবল উন্মোচিত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় চার নেতার একজন তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫২ সালে ছিলেন ২৬ বছরের তরুণ। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রায় প্রতিদিনই দিনলিপি লিখেছেন তিনি। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিনি দিনলিপি লিখতেন ইংরেজি ভাষায়। তাতে ওই দিন ঘুম থেকে ওঠার সময়টা শুরুতেই উল্লেখ করা থাকত। আর থাকত সারা দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ। ঘুমাতে যাওয়ার সময়টা লিখতেন আর সেদিনের আবহাওয়ার অবস্থা সম্পর্কে ছোট্ট একটি মন্তব্য থাকত।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার সূত্রে এই দিনলিপিগুলো লেখক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমরের হাতে আসে। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল গ্রন্থে এই দিনলিপির কিছু অংশ হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ের ভূমিকায় বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ‘তাঁর (তাজউদ্দীন) সঙ্গে আলাপের সময় তিনি কথায় কথায় এই ডায়েরীর উল্লেখ করেন, কিন্তু সেই সঙ্গে বলেন যে, তার কোনো গুরুত্ব নেই।... আমি কিছু কিছু পাতা উল্টিয়ে বুঝতে পারি যে, তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ঠিকমতো লেখার ক্ষেত্রে ডায়েরীটি খুব সাহায্য করবে।’ বদরুদ্দীন উমরের কাছে এই দিনলিপিগুলো ছিল বলেই এগুলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

২১ ফেব্রুয়ারির ওই মাহেন্দ্রক্ষণটির ১৫ দিন আগে তাজউদ্দীন তাঁর এলাকার ফাওগাঁও এম ই স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্কুলের জন্য তহবিল বরাদ্দ এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকের ব্যাপারে কথা বলতে একাধিক সরকারি দপ্তরে যাওয়ার তাগিদ ছিল তাঁর। ফলে বিস্ফোরণোন্মুখ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে সেখানে মিনিট বিশেক অবস্থান করে তিনি বেরিয়ে আসেন।

দিনলিপিতে তাজউদ্দীন লিখেছেন, ‘পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশাল জনসমাবেশ। মেডিকেল কলেজ ও অ্যাসেমব্লি হলের কাছে এইমাত্র পুলিশের টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ার বিষয়ে লোকজন বলাবলি করছিল।’

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমে ডিপিআই অফিস ও পরে পুরান ঢাকায় এসডিও অফিসে যান। শ্রীপুরের উদ্বাস্তুদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থার জন্যও কথা বলেন তিনি। বেলা তিনটার দিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ছাত্রজনতার ওপর প্রথম গুলি চালায়, তাজউদ্দীন আহমদ তখন এসডিও অফিসে অবস্থান করছিলেন।

বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি প্রথম জানতে পারেন গুলিবর্ষণের কথা। এরপরই দ্রুত চলে আসেন মেডিকেল কলেজে। দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, ‘ডা. করিম ও আমি মেডিকেল কলেজে গেলাম। পুলিশের গুলিতে আহত ও নিহতদের মৃতদেহ দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। ডা. করিম চলে গেলেন। আমি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ইতস্তত ঘোরাফেরা করে রাত ১১টায় যোগীনগরে ফিরে গেলাম।’

রাত সাড়ে তিনটায় পুলিশ বাহিনী পুরান ঢাকার যোগীনগরে যুবলীগের অফিস ও সংলগ্ন বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়। ভোর চারটায় পুলিশ চলে যায়।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারির ভুক্তিতে তাজউদ্দীন লিখেছেন, ভোর ৬টায় তিনি সাইকেল চালিয়ে আবার মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে আসেন। দুপুরের পর তিনি আবার মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে আসেন। সন্ধ্যায় এফ এইচ এম হলের অ্যাসেমব্লি হলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত তিনি ছাত্রদের একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন।