তারেক ও গঠনতন্ত্র বিতর্কে বিএনপি

তারেক রহমান। ফাইল ছবি
তারেক রহমান। ফাইল ছবি
>
  • বিএনপি গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়েছে।
  • ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’র বিষয় রয়েছে।
  • ৭ নম্বর ধারা বাতিলকে কৌশল বলছে বিএনপি।
  • তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে বিতর্কে পড়েছে বিএনপি। এর আগে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ব্যক্তি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার অযোগ্য হবেন বলে গঠনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা হঠাৎ করে বাদ দিয়ে দলটি সমালোচনার মুখে পড়েছে।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ তাঁরা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণার ১০ দিন আগে ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়ে বিএনপি দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেয়।

ইসি সূত্র বলছে, নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল যদি সম্মেলন করে এবং তাতে যদি গঠনতন্ত্র সংশোধন করে, নিয়মানুযায়ী সেটা ইসিতে জমা দিতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু না থাকলে এ ক্ষেত্রে ইসির করণীয় তেমন কিছু নেই। কিন্তু দুই বছর আগে হওয়া বিএনপির জাতীয় সম্মেলনে এই ধারা সংশোধন বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা বাতিল করাটা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি কৌশলগত ব্যবস্থা। আর তারেক রহমানের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। কারণ, বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৮(গ) ধারায় বলা আছে, চেয়ারম্যানের সাময়িক অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হবেন।

খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা ও গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসে। তারা মনে করে, এভাবে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা অগণতান্ত্রিক। দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত এবং দেশে অনুপস্থিত কাউকে দলের নেতৃত্ব দেওয়াটা অশোভন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বিষয়টিকে রাজনীতিতে নীতিনৈতিকতাহীনতার প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নাম নেই, দণ্ডিত নয়, এমন কাউকে দায়িত্ব দিতে পারত বিএনপি। তা না করে তারা গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন এনেছে। এর অর্থ হচ্ছে তারা জিয়া পরিবারের বাইরে যাবে না।

অবশ্য বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান দাবি করেন, আলোচনা করেই তাঁরা গঠনতন্ত্রে এই পরিবর্তন এনেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা হচ্ছে, জোর করে প্রমাণ করা হচ্ছে এবং সাজাও হচ্ছে। তাহলে উপায় কী?’

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সরকার জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপিকে ভাঙা অথবা দলে জিয়া পরিবারের বিকল্প নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হতে পারে—বিএনপির নেতাদের কাছে এমন তথ্য আছে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়ার সাজার পর ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ব্যক্তি দলের নেতৃত্বের অযোগ্য হবেন বলে যে কথাটি গঠনতন্ত্রে ছিল, সেটা সামনে আনা হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা বাদ দেওয়া হয়।

গঠনতন্ত্র পরিবর্তন নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা কড়া সমালোচনা করলেও বিএনপি এর জবাব দিচ্ছে না। ২০১৬ সালের মার্চে জাতীয় সম্মেলনের এত দিন পর কোন প্রক্রিয়ায় গঠনতন্ত্রে এই পরিবর্তন আনল, তা জানা যায়নি। নেতারা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, গঠনতন্ত্রের এই ধারাটি বাতিল এবং তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে বিএনপির নেতাদের সন্দেহ আরও বেড়েছে।

বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা বাদ দেওয়ার পরদিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কী অদ্ভুত বিএনপি, কী অদ্ভুত তাদের গঠনতন্ত্র! মামলা-হামলার ভয়ে তাদের গঠনতন্ত্র পাল্টে ফেলেছে।

খালেদা জিয়ার সাজা, কারাগারে যাওয়া এবং তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে সরকারি দলের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকেবলেন, এটা দেশের শান্তিপূর্ণ অবস্থা এবং আগামী নির্বাচনের বিরুদ্ধে একটি বড়সড় ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, বেগম জিয়াকে যেভাবে যেখানটায় বন্দী রাখা হয়েছে, এটা কি ঠিক? প্রধানমন্ত্রী নিজের ১৫টি মামলা তুলে নিলেন। অথচ এক-এগারোর সময় যিনি মাইনাস টু ফর্মুলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেই মানুষটিকে এখন রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের কারও কারও মধ্যে যে একটা অস্বস্তি ছিল, এখন তা নেই। তারেক রহমানও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। গত কয়েক দিনে তারেক রহমান চারটি সভায় মুঠোফোনে বক্তব্য দিয়েছেন।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপিতে পরিপূর্ণ স্বস্তি বিরাজ করছে। কারণ, দল আইন ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে। তারেক রহমান না থাকলে তৃতীয় কেউ নেতৃত্ব দিতেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের এত অস্বস্তি কেন?

বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারি মহল খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বিএনপির নেতৃত্ব থেকে সরাতে চাইছে—এমন আশঙ্কা এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা দ্রুত গঠনতন্ত্রের ওই ধারা বাতিল এবং তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা মনে করেন, দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জিয়া পরিবারের বাইরে কোনো নেতৃত্ব মেনে নেবেন না।

খালেদা জিয়া বন্দী হওয়ার পর আগে-পরে বিএনপির নেতাদের মুখে বেশি উচ্চারিত হয়েছে দলের ভাঙন এবং দলীয় ঐক্যের কথা। দুটি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বেশ সতর্ক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে নেওয়ার পর দল আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।