কপিরাইট করতে আগ্রহ কম

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

• সৃজনশীল পণ্যের মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় আইন আছে, দপ্তর আছে।
• নিবন্ধনের প্রবণতা দেখা যায় না।
• সৃজনশীল পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়ছে মুনাফালোভীরা।
• বেশি নকল হচ্ছে জনপ্রিয় লেখকের বই এবং অডিও-ভিডিও সিডি।
• ‘পাইরেটেড’ বা নকল পণ্য উদ্ধারে টাস্কফোর্সের অভিযানও বন্ধ।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এবার ইতিমধ্যেই দেড় হাজারের বেশি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একটিরও আইনানুগ কপিরাইট নিবন্ধন করা হয়নি। শুধু নতুন বইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, কোনো সৃজনশীল মেধাসম্পদেরই আইনগত সুরক্ষা নেওয়ার আগ্রহ দেশে সৃষ্টি হয়নি। সাধারণত কেউ কপিরাইট নিবন্ধন করে না।
এই সুযোগে সৃজনশীল পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়ছে মুনাফালোভীরা। ‘পাইরেটেড’ বা নকল পণ্য উদ্ধারে টাস্কফোর্সের অভিযানও বন্ধ। মেধাসম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নকল হচ্ছে জনপ্রিয় লেখকের বই এবং অডিও-ভিডিও সিডি। প্রকাশ্যেই এসব বিক্রি হচ্ছে ফুটপাত থেকে অভিজাত এলাকার বিপণিবিতানে।

এ বিষয়ে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত কপিরাইট কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে কপিরাইট নিবন্ধক জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার বইমেলায় প্রকাশিত কোনো বইয়ের জন্য এখনো কেউ নিবন্ধনের আবেদন করেনি। কপিরাইট নিবন্ধন করলে মেধাসম্পদের ওপর আর্থিক ও নৈতিক অধিকার নিশ্চিত হয়। প্রণেতার পাশাপাশি তাঁর উত্তরাধিকারীও আইনগত স্বীকৃতি পান। কিন্তু আমাদের দেশে নিজেদের সৃজনশীল মেধাসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেটি আইন অনুসারে নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে কারও বিশেষ আগ্রহ নেই। বলা যায়, তারা এ সম্পর্কে প্রায় উদাসীন। সে কারণে আইন থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় নকলকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’

কপিরাইট বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। মানুষের মেধা, মনন, সৃজনশীলতা থেকে যা সৃষ্টি বা উৎপন্ন হয়, আইনি পরিভাষায় তাকে বলে মেধাসম্পদ। কপিরাইট হলো এর আইনি স্বীকৃতি।
নিজের সৃজনশীল সম্পদ এবং এ ধরনের কোনো সংগঠন কপিরাইট আইনে নিবন্ধন করা যায়। সৃজনশীল সম্পদের মধ্যে রয়েছে সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, রেকর্ড, কম্পিউটার সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপস, কম্পিউটার গেম, ই-মেইল, ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বেতার ও টিভির সম্প্রচার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তাঁদের সমিতি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থার (আইপিএ) সদস্য হয়েছে। বাংলাদেশের বই এখন বিদেশে বাজারজাত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই বইয়ের আইনানুগ কপিরাইট করা আবশ্যক। তাঁরা এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করতে চেষ্টা করছেন।
২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পাঁচ বছরের মধ্যে গত বছর কপিরাইট আইনে ৬টি বিষয়ে নিবন্ধন হয়েছে মোট ৩ হাজার ১৩৪টি সৃজনশীল কর্ম। এগুলোর বিষয়বস্তু হলো সাহিত্য, সফটওয়্যার, শিল্পকর্ম, ওয়েবসাইট, সংগীত ও চলচ্চিত্র। এর মধ্যে চলচ্চিত্র নিবন্ধিত হয়েছে সবচেয়ে কম, মাত্র ১৫টি। আর গত বছরই প্রথম একটি আলোকচিত্র নিবন্ধিত হয়েছে।

যা এখনো নিবন্ধিতই হয়নি
আজ পর্যন্ত দেশে কোনো ভাস্কর্য, চারুশিল্প, স্থাপত্য নকশা, বিজ্ঞাপন এবং মঞ্চ বা টিভিতে প্রচারিত কোনো নাটক বা অনুষ্ঠান নিবন্ধিত হয়নি। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনও এখনো নিবন্ধিত হয়নি। অনেক সময় সাংস্কৃতিক সংগঠন, গান বা নাটকের দলে মতপার্থক্যের কারণে দল ভাগ হয়ে যায়। তখন সংগঠনের নাম কারা ব্যবহার করবেন, এ নিয়ে সমস্যা হয়। বিষয়টি আদালতে গড়ালেও সুরাহা হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কপিরাইট থাকলে এমন পরিস্থিতে জটিলতার সৃষ্টি হয় না।

টাস্কফোর্সের অভিযান হচ্ছে না
বই বা সিডির নকল প্রতিরোধে অভিযান চালানোর দায়িত্ব কপিরাইট অফিসের। এ বিষয়ে তাদের একটি টাস্কফোর্সও আছে। কিন্তু এই টাস্কফোর্সের কোনো কার্যক্রম নেই। কপিরাইট নিবন্ধক জাফর রাজা চৌধুরী বলেছেন, মাঠপর্যায়ে আইন প্রয়োগ করার মতো কোনো জনবল, যানবাহন বা অর্থ বরাদ্দ তাঁদের নেই। আর নকলের কোনো অভিযোগও তাঁদের কাছে আসছে না। তবে তাঁরা নকল প্রতিরোধে অভিযান চালাতে আগ্রহী। প্রকাশক সমিতির নেতাদের অভিযোগ, আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। কারণ, নকলকারীদের সাজা হয় না, সহজেই জামিন পেয়ে যায়।

কীভাবে নিবন্ধন করতে হয়
সৃজনশীল সম্পদের স্বত্ব সুরক্ষার জন্য কপিরাইট অফিসে সেটির নিবন্ধন করাতে হয়। কপিরাইট অফিস জানায়, এই প্রক্রিয়াও খুব সহজ। নির্ধারিত আবেদনপত্র পূরণ করে আবেদন করতে হয়। সঙ্গে লাগে প্রতিটির ক্ষেত্রে এক হাজার টাকার ট্রেজারি চালান। দুই কপি ছবি, পণ্যটি নিজের বলে হলফনামা, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি আর যে সৃজনশীল পণ্যটি নিবন্ধন করা হবে, তার দুটি কপি এবং সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই কাজ এখন সরাসরি আগারগাঁওয়ের কপিরাইট অফিসে (জাতীয় গণগ্রন্থাগারের তৃতীয় তলায়) না গিয়ে অনলাইনেও করা যায়। আবেদন জমা দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে যদি অন্য কেউ ওই সম্পদের বিষয়ে আপত্তি না দেন, তবে যাচাই-বাছাই করে আবেদনকারীকে ওই সম্পদের অধিকারী হিসেবে আইনি সনদ দেওয়া হয়।