পুলিশের ঘুষ মাদকে উশুল

• ঘুষ লেনদেনে পুলিশে কোনো রাখঢাক নেই।
• পুলিশেরই একজন ঘুষ নিচ্ছেন অন্যজনের কাছ থেকে।
• সেই অর্থ উশুল হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিয়ে।

পুলিশের ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে দেশে মাদক ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। শুধু মাদক ব্যবসা নয়, বাহিনীতে লোকবল নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিতেও ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। এই ঘুষের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাও জড়িত। গতকাল রোববার অপরাধবিষয়ক ত্রৈমাসিক সভায় পুলিশের কর্মকর্তাদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সম্মেলনকক্ষে এই সভা হয়।

সভার আলোচনার ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এ কে এম শহিদুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে ঠিকই। তবে মাদক নির্মূলে পুলিশ কঠোর অবস্থানও নিয়েছে। এর সঙ্গে পুলিশের কেউ জড়িত হলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে।

দেশের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি তিন মাস পরপর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই বৈঠকে গেল সময়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার পাশাপাশি আগামী তিন মাসের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকামিবলার কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়। গতকালের সভায় দেশের সব জেলার পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহানগর, রেঞ্জ ও অন্যান্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাহিনীতে নতুন মহাপরিদর্শক হিসেবে জাবেদ পাটোয়ারী যোগদানের পর এটাই প্রথম অপরাধবিষয়ক সভা। সভায় নির্বাচনের বছরের আইনশৃঙ্খলা, মাদক পরিস্থিতি, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ, কনস্টেবল নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।

সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এবারের সভায় নানা আলোচ্য বিষয় থাকলেও মাদক নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। নতুন আইজিপির উপস্থিতিতে কর্মকর্তারা তাঁদের নিজস্ব সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এক পুলিশ কর্মকর্তা মাদক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, কাকের মাংস কাকে খায় না, কিন্তু পুলিশের মাংস যদি পুলিশ খায়, তাহলে অপরাধ বন্ধ হবে কীভাবে? ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো থানায় নতুন ওসি যোগদান করতে হলে তাঁকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। শুধু ওসি নন, এসআই ও এএসআই বদলি করতেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এত টাকা ঘুষ দেওয়ার পর ওই কর্মকর্তা মাদকের সঙ্গে যুক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ঘুষের এই অর্থ তিনি তুলবেন কী করে? আবার জেলার প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা যদি ওসির কাছ থেকে টাকা নেন, তাহলে তাঁকে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে বলবেন কীভাবে? মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও ডিআইজিরাও টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিচ্ছেন। যে কারণে মাদকের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ কমছে না, মাদক বন্ধও হচ্ছে না। পুলিশের ঘুষের টাকা মাদকে উশুল হচ্ছে।

দেশে প্রতিবছর শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা)। আর্থিক, সামাজিক, মানবিক—নানাভাবে ইয়াবার ভয়াবহতা দেশজুড়ে ছড়ালেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ খুব সামান্যই। ইয়াবা বন্ধে মাদকদ্রব্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ছাড়া আর কোনো তৎপরতা নেই। মাদকের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ পুরোনো। এ নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬৭ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হযেছে। কিন্তু তারপরও পুলিশের বিরুদ্ধে মাদকে জড়িত থাকার অভিযোগ কমছে না।

পুলিশের আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, জুনিয়রদের কাছ থেকে সিনিয়ররা যদি লজ্জা পেতে না চান, তাহলে এখনই সংশোধন হোন। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায়ভার প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সভায় পুলিশের নিয়োগে দুর্নীতি নিয়েও কথা বলেন কর্মকর্তারা। এক পুলিশ কর্মকর্তা আইজিপির উদ্দেশে বলেন, অধিকাংশ ডিআইজি এক থানা থেকে আরেক থানায় ওসি নিয়োগ (পোস্টিং) দেন টাকার বিনিময়ে। এক থানা থেকে আরেক থানায় এসআই বদলি করতে লাখ লাখ টাকা নেন। কনস্টেবলকে এএসআই পদে পদোন্নতি দিতেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেন। তিনি বলেন, কনস্টেবল নিয়োগে এসপির ঘুষ নেওয়া বন্ধ করতে পারলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে। এই ঘুষের সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক নেতাও জড়িত।

সভায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মুখে এ ধরনের মন্তব্য শুনে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান কর্মকর্তাদের বলেন, এসব কথা শুনে আপনাদের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ থাকে, তাহলে এসব কাজ থেকে বিরত থাকবেন।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি সত্যিই এমন বলা হয়ে থাকে যে নিয়োগ-পদোন্নতিতে বিশাল অঙ্কের ঘুষ লাগে, পরে সেটা রিকভারি করতে হয়, তাহলে বলব এটা মানসিকতারও বিষয়। ৫০ লাখ টাকা লগ্নি করে তো সৎভাবে উপার্জন করা সম্ভব। নৈতিক অবক্ষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। একজন আরেকজনকে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করছে। এটা পুরো বাহিনীর জন্য অশনিসংকেত।’

 সভায় উপস্থিত একজন কর্মকর্তা বলেন, আইজিপি সভায় বলছেন যে পুলিশের বিরুদ্ধে যে কথাগুলো উঠেছে তা সবই সত্য, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কনস্টেবল নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে, যাতে এ নিয়োগ নিয়ে কোনো ধরনের অভিযোগ শোনা না যায়। আইজিপি বলেন, সবাই মিলে চেষ্টা করলে সুষ্ঠুভাবে কনস্টেবল নিয়োগ সম্পন্ন করা সম্ভব।

আইজিপি আরও বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারির পরিস্থিতি যেভাবে দমন করা হয়েছে, এরপর কোনো ঘটনা ঘটলেও একইভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তবে কোনো গণগ্রেপ্তার করা হবে না। লক্ষ্য নিয়ে গ্রেপ্তার করতে হবে। যেমন দুষ্ট, সন্ত্রাসী—এমন লোকদের ধরতে হবে। তিনি বলেন, কোনো সাধারণ ও নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। থানাকে পুলিশি সেবা প্রদানের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে, তাদের সমস্যা ও অভাব-অভিযোগ শুনতে হবে।

আইজিপি বলেন, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশের অনন্য অবদান রয়েছে। বর্তমানে দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আছে। জঙ্গিরা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

সভায় ২০১৭ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে তিন মাসের অপহরণ, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদকদ্রব্য, চোরাচালান দ্রব্য, অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার, সড়ক দুর্ঘটনা, গাড়ি চুরি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও পুলিশের ওপর হামলার মামলাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিন মাসে সারা দেশে ৫২ হাজার ৪৪৬টি মামলা হয়েছে, যা গত জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭ সময়ের তুলনায় কম। এই সময়ে সারা দেশে খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, চোরাচালান, সড়ক দুর্ঘটনা, গাড়ি চুরির মামলা এর আগের তিন মাসের তুলনায় কমেছে। তবে এই তিন মাসে ডাকাতি মামলা বেড়েছে বলে সভায় জানানো হয়।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক নেতারা পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করলে তা শুনবেন কেন? তাঁরা যদি মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকেন, তাহলে কেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কেউ মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এর বাইরে যাঁরা জড়িত তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। তা না হলে দিনে দিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।