মাতৃভাষার চর্চা নেই এ দেশের রাখাইনদের

• দেশের ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি রাখাইন সম্প্রদায়।
• বলতে জানলেও রাখাইন ভাষায় লিখতে-পড়তে জানেন এ দেশে এমন লোকজন হাতেগোনা।
• রাখাইনদের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও নেই ভাষার চর্চা।

রাখাইন ভাষার সংখ্যা। ছবি: প্রথম আলো
রাখাইন ভাষার সংখ্যা। ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৯০ হাজারের মতো রাখাইন জনগোষ্ঠীর বসবাস। চর্চার অভাবে দেশের অন্যতম এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যরা মাতৃভাষায় দখল হারাচ্ছে। বলতে জানলেও রাখাইন ভাষায় লিখতে পড়তে জানেন এ দেশে এমন লোকজন হাতেগোনা। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও নেই ভাষার চর্চা। তাদের প্রায় কেউই মাতৃভাষায় লিখতে ও পড়তে পারে না। পাকিস্তান আমলে সীমিত আকারে কিছু এলাকার বিদ্যালয়ে রাখাইন ভাষা পড়ানো হলেও এখন পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকের অভাবে এই কার্যক্রম থেমে গেছে স্বাধীনতার পরপরই। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন রাখাইন নাগরিক সমাজের সদস্যরা।

রাখাইন ভাষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন রামু বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মংহ্লা প্রু পিন্টু। গতকাল রোববার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাখাইন জনগোষ্ঠীর ৯৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে পড়তে পারে না। অবশিষ্ট চার শতাংশ ছেলে-মেয়ে বাবা-মার কাছে কিংবা বৌদ্ধবিহারের পাঠাগারে গিয়ে মাতৃভাষা শিখেছে। রাখাইন শিক্ষকের অভাব, পাঠ্যপুস্তকের সংকট এবং সরকারি উদ্যোগ না থাকায় রাখাইন ভাষার চর্চা থেমে গেছে। এর ফলে রাখাইনদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সংগীত, নৃত্য ও লোকগাথা হারিয়ে যাচ্ছে।

রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মংহ্লা প্রু পিন্টু আরও বলেন, পাকিস্তান আমলে কক্সবাজার শহরের টেকপাড়া বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে রাখাইন ভাষা শেখানো হতো। সহশিক্ষার এই কার্যক্রম ছিল টেকনাফ, হ্নীলা কক্সবাজার, রামুসহ জেলার আরও আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এসব বিদ্যালয়ে রাখাইন শিশুরা লেখাপড়া করত। তবে ১৯৭৪ সালের পর থেকে এই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

গবেষক মংহ্লা প্রু পিন্টুর বাড়ি জেলার চকরিয়ার হারবাং এ। হারবাং বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি পড়েছেন। সেখানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পড়ানো হতে রাখাইন ভাষা। তখন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক ছিলেন মাসিন রাখাইন। এখন তিনি বৃদ্ধা, বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন।
মাসিন রাখাইন (৬৭) প্রথম আলোকে বলেন, রাখাইন অভিভাবকেরা মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন নন। তাঁরা মনে করেন, রাখাইন ভাষা শিখলে তাঁদের সন্তানেরা বাংলায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। যে কারণে কক্সবাজারে রাখাইন ভাষা শেখানোর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।

কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ (সংরক্ষিত) এথিন রাখাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাখাইন ভাষার চর্চা না থাকায় আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যও হারিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন ছেলে-মেয়েরা বাংলা ও ইংরেজি নিয়ে শিক্ষিত হলেও মাতৃভাষার মর্ম তারা বুঝতে পারছে না। এ জন্য আগের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা হিসেবে রাখাইন ভাষার পড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।’

রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন সূত্র মতে, দেশের ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি রাখাইন সম্প্রদায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন ৯০ হাজারের মতো রাখাইন জাতির বসতি রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি রাখাইন বাস করেন কক্সবাজার জেলায়। অবশিষ্ট রাখাইনরা থাকে পটুয়াখালী, বরগুনা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম মহানগরে।
কক্সবাজার শহরের চাউলবাজার এলাকায় রাখাইন ভাষা শেখার একটি পাঠশালা আছে। চ খিন রাখাইন নামের এক নারী ২০১৭ সালে পাঠশালাটি চালু করেছেন। চ খিন মাতৃভাষা শিখেছেন তাঁর চাচার কাছ থেকে। সেই শিক্ষা সম্বল করে পাঠশালায় ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। সপ্তাহে দুদিন শুক্র ও শনিবার বিকেলে দুই ঘণ্টা করে পড়ানো হয় শিশুদের।
গত শনিবার বেলা তিনটায় পাঠশালায় গিয়ে দেখা গেছে, দোতলা বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে শিশুদের রাখাইন ভাষা শেখাচ্ছেন চ খিন। সেখানে পড়ছে মাছেন হ্লা (১২), জিমা রাখাইন (১১), আম্মাসিন রাখাইনসহ (৮) অনেকে।

এর মধ্যে মাছেন হ্লা পড়ে শহরের কক্সবাজার কেজি অ্যান্ড মডেল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। সে জানায়, মাতৃভাষা শিখতে তার বাবা তাকে চ খিনের পাঠশালায় পড়তে পাঠিয়েছেন।
মাছেন হ্লার বাবা মংটিউমা রাখাইন (৪২) সোনালী ব্যাংক কক্সবাজার শাখার কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘নিজের মাতৃভাষা জানাটা জরুরি। তাই সন্তানকে পাঠশালায় পাঠিয়েছি।’
রাখাইন ভাষা শিক্ষার শিক্ষক চ খিন রাখাইন (৪০) বলেন, কয়েকজন অভিভাবকের অনুরোধে তিনি রাখাইন ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছেন। তবে সন্তানদের ভাষা শেখানোর আগ্রহ এখনকার সব অভিভাবকদের মধ্যে নেই।