খালেদা জিয়া অর্থনৈতিক অপরাধী: আদালত

কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ সাজাপ্রাপ্ত ছয়জন আসামিকে ‘রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আদালত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার পর্যবেক্ষণে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫ এর বিচারক আখতারুজ্জামান এ কথা বলেছেন।

৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পাঁচজনের দশ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। রোববার এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের (৬৩২ পৃষ্ঠা) অনুলিপি খালেদা জিয়া ও দুদকের আইনজীবীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এই মামলায় দণ্ডিত অপর আসামিরা হলেন সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমান। এর মধ্যে পলাতক আছেন তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান। খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, এই মামলার দণ্ডিত আসামিদের পরস্পরের যোগসাজশে সরকারি এতিম তহবিলের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। খালেদা জিয়া সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও খালেদা জিয়াকে সরকারি এতিম তহবিলের ব্যাংক হিসাব খুলতে সহায়তা করেছেন এবং দুটি প্রাইভেট ট্রাস্টের অনুকূলে সরকারি অর্থের চেক বেআইনিভাবে দিয়েছেন, যা অপরাধে সহায়তার শামিল। আসামি তারেক রহমান, মমিনুর রহমান ও শরফুদ্দীন আহমেদ কৌশল অবলম্বন করে সরকারি এতিম তহবিলের টাকা পরস্পরের সহযোগিতায় আত্মসাৎ করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। আদালত মনে করেন, এই মামলার ছয় আসামিই প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।

রায়ের কপির ২৪৭ নম্বর পৃষ্ঠায় আদালত বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কীভাবে একটি বেসরকারি ট্রাস্টের দাপ্তরিক ঠিকানা হতে পারে তা বোধগম্য নয়। খালেদা জিয়া সাফাই সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি যে, সেখানে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দাপ্তরিক ঠিকানা ছিল না।

আদালত মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল একটি সরকারি তহবিল। ওই তহবিলের টাকা এ দেশের এতিম ও এতিমখানার উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার বিধান আছে কিংবা থাকা উচিত ছিল। খালেদা জিয়া সেসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তার আবশ্যক দায়িত্ব ছিল, ওই তহবিলের টাকা যথাযথ নিয়মে খরচ হচ্ছে কী না তা দেখা।
আদালত আরও বলেছেন, সেসময় প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা অবস্থায় সরকারি প্রতিটি অর্থের হিসাবের জিম্মাদার ছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর দুই ছেলে এবং স্বামীর ভাগনে ছিলেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ট্রাস্টি। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা ট্রাস্টের হিসাবে স্থানান্তরিত হলো, অথচ আসামি খালেদা জিয়া জানতেন না বলে যে দাবি করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।

 খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেছেন, রায়ের অনুলিপি পাওয়ায় তাঁরা এখন উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। আর দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেছেন, রায়ের কপি আগামীকাল (মঙ্গলবার) দুদকে জমা দেবেন। এরপর কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেভাবে তাঁরা কাজ করবেন।

আদালত মনে করেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠা করা হলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি এতিম তহবিলের টাকা বেআইনিভাবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য খালেদা জিয়া ও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না। কেননা সরকারি এতিম তহবিলের টাকা স্থানান্তরের পর সেই টাকা যথাযথভাবে খরচ হলো কিনা তা দেখভাল করা তাঁদের (খালেদা জিয়া ও কামাল সিদ্দিকী) দায়িত্ব।

আদালত আরও মনে করেন, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা পাওয়ার পর তা সদ্ব্যবহার না করে তারেক রহমান ও মমিনুর রহমান সেই টাকা সোনালী ব্যাংক থেকে প্রাইম ব্যাংকে স্থানান্তর করেন। এমন কাজের দায় তাঁরা কোনোভাবে এড়াতে পারেন না।

রায়ে আদালত বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বগুড়ার গাবতলী থানার দাড়াইলে জমি কেনা হলেও সেখানে এখন পর্যন্ত কোনো স্থাপনা তৈরি করা হয়নি। আগে কিংবা বর্তমানে কোনো সময়ই সেখানে এতিমখানা স্থাপন করা হয়নি। অর্থাৎ খালেদা জিয়া ও কামাল সিদ্দিকী জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দিয়েছেন অথচ কোনো এতিমখানা তৈরি করা হয়নি। নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার অপরাধের দায় তাঁরা কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। আর তারেক রহমান ও মমিনুর রহমান ওই ট্রাস্টের ট্রাস্টি হয়ে সরকারি টাকা থেকে চার লাখ টাকা তুলে নেন। এর মধ্যে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দিয়ে ২ দশমিক ৭৯ একর জমি কিনলেও সেখানে কোনো স্থাপনা তৈরি করেননি কিংবা কোনো এতিমখানা বানাননি। এভাবে তাঁরা টাকা আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন।

আদালত বলেছেন, ১৯৯১ সালের ৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের অনুদান হিসেবে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার বাংলাদেশে আসে। এটা জমা হয় প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে। আসামিপক্ষ দাবি করেছিল, ওই টাকা এসেছিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে, বাস্তবে তা প্রমাণ করতে পারেনি। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে এফডিআর খোলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। রায়ে বলা হয়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দাপ্তরিক ঠিকানা ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোড। অথচ এফডিআর খোলার ফরমে ট্রাস্টের দাপ্তরিক ঠিকানা কারওয়ান বাজারের বিসএসইসি ভবন লেখা আছে।

সাবেক সাংসদ সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন সম্পর্কে আদালত বলেছেন, তাঁরা ট্রাস্টি না হয়েও পরস্পরের সহায়তায় সরকারি এতিম তহবিলের টাকা আত্মসাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।

খালেদা জিয়া সম্পর্কে আদালত বলেছেন, অস্তিত্ববিহীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ঠিকানা ৬ মইনুল হোসেন রোড; যা ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আবাসিক ঠিকানা। ওই বাসা সরকারি বাসা না হলেও তিনি সেখানে বসবাস করতেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদের যাবতীয় সুযোগ গ্রহণ করে সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন বলে ধরে নিতে হবে। সে কারণে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মতো বেসরকারি ট্রাস্টের ঠিকানা ব্যবহার করার কথা নয়।

সৌদি আরব থেকে আসা টাকা কীভাবে সরকারি টাকা—সে ব্যাপারে আদালত বলেছেন, সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে যে টাকা আসে তা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। তিনি তা ফেরত দিতে পারতেন, কিন্তু তা না করে গ্রহণ করার ফলে ওই টাকা সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়। টাকা জমা হয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি এতিম তহবিলের চলতি হিসাবে।

আদালত মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব কামাল সিদ্দিকী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদন গ্রহণ করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে টাকা দেন। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর সচিব কামাল সিদ্দিকী সরকারি কর্মচারী হয়েও সরকারি অর্থ সরকারি উদ্দেশ্যে ব্যয় করেননি। বরং একটি বেসরকারি ট্রাস্টের অনুকূলে টাকা দিয়ে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ এর ২ ধারার অপরাধ করেছেন।

আদালত বলেছেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে স্বীকার করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামের একটি হিসাব সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখায় খোলা হয়েছিল, সেখানেই ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার জমা হয়।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক শুনানির সময় অভিযোগ করেন, তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদসহ কয়েকজন সাক্ষী জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নথি তৈরি খালেদা জিয়াকে ফাঁসিয়েছেন। এ ব্যাপারে আদালত রায়ে বলেছেন, জাল-জালিয়াতির অভিযোগ এনে এজে মোহাম্মদ আলী সাক্ষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু দেখা যায়, সচিবালয় নির্দেশমালার ৪৭ ও ৪৮ দফা অনুযায়ী অতিরিক্ত নথি খোলার সুযোগ আছে। এ জে মোহাম্মদ আলী যে বলেছিলেন, সচিবালয়ের নির্দেশিকা অনুযায়ী অতিরিক্ত নথি খোলার সুযোগ নেই, সেই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। আর রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় সাক্ষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রায়ে বলা হয়, খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয়েছে যে, কুয়েতের আমিরের পক্ষ থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতি অম্লান করে রাখার জন্য দুটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠার জন্য সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার অনুদান পাঠানো হয়। কিন্তু আসামিপক্ষের এই যুক্তি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কুয়েতের আমির যে টাকা পাঠিয়েছেন, সেটা কুয়েত দূতাবাসের চিঠি দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে। আদালত এ ব্যাপারে বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করা হয় ১৯৯৩ সালের ৯ অক্টোবর। ট্রাস্টের নামে হিসাব খোলা হয় ১৯৯৩ সালের ৯ অক্টোবর। প্রশ্ন আসে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠনের দুই বছর আগে ওই ট্রাস্টে কুয়েতের আমির কীভাবে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার অনুদান দেন? খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে জমা দেওয়া কুয়েত দূতাবাসের চিঠিকে আদালত অবৈধ কাগজ বলে উল্লেখ করেন।