নির্বাচন হোক মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশের কারণে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি বড় ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও একাধিক মার্কিন বিশেষজ্ঞ।

মার্কিন বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, রায়ের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একচেটিয়া শাসন প্রতিষ্ঠায় অধিক উৎসাহী হয়ে উঠবে। অথচ গণতান্ত্রিক সাফল্যের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে ঘাটতি আছে। তাঁদের মতামত হচ্ছে, আজকের যে বাংলাদেশ, তা কেবল নামেই গণতান্ত্রিক।

খালেদা জিয়ার রায় প্রসঙ্গে প্রথম আলোর কাছে এক লিখিত বিবৃতিতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র জানান, এই রায়ের বিষয়ে তাঁরা অবগত রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁরা আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে সেখানে প্রত্যেক মানুষ কোনো রকম প্রতিশোধের ভীতি ছাড়া মুক্তভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়। বাংলাদেশে যাতে দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে এমন মুক্ত, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, যুক্তরাষ্ট্র তেমন সুযোগ সৃষ্টিতে সমর্থন করে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ সরাসরি উল্লেখ না করে মুখপাত্রটি বলেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুক্ত, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে ভিন্নমত প্রকাশ খুবই জরুরি।

বিস্মিত নন মাইলাম
খালেদা জিয়ার রায়ের ব্যাপারে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও সরাসরি ও তির্যক। তিনি মনে করেন, খালেদা জিয়ার বিচারের রায় দেখে তিনি মোটেই বিস্মিত হননি। সামনে সাধারণ নির্বাচন, তার আগে নিজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেত্রীকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক প্রমাণিত হতে পারে। তবে এর বিপদও রয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে বেগম জিয়া নিজেকে একজন ‘নির্যাতিতা’ হিসেবে উপস্থিত করার চেষ্টা করতে পারেন। তবে বিএনপি যদি ফের নির্বাচন বয়কটের কথা ভাবে, সেটি হবে মারাত্মক ভুল।

উইলিয়াম মাইলাম ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০১ পর্যন্ত পাকিস্তানেও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত এই কূটনীতিক বর্তমানে ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার হিসেবে কর্মরত। নিজ দপ্তর থেকে তিনি টেলিফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন।

রাষ্ট্রদূত মাইলাম মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করা বিএনপির জন্য বড় ধরনের জুয়া খেলা ছিল, যে খেলায় তারা হেরে গেছে। সেই একই খেলা আবারও খেললে তার ফলাফল খুব ভিন্ন হবে বলে মনে হয় না। মাইলাম মনে করেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে সফল হতে হলে বিএনপিকে মধ্যপন্থী দল হিসেবে রূপান্তরিত হতে হবে। তাঁর ধারণা, বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নতুন, বিশেষত তরুণ নেতৃত্ব খুঁজে নেওয়া। খালেদার পুত্র তারেক রহমানকে এই দলের দায়িত্ব দেওয়া একটি ভুল হবে বলে মনে করেন এই কূটনীতিক। তিনি বলেন, ‘আমার তো মনে হয়, তারেক এখন যেমন পূর্ব লন্ডনে আছেন, তাঁর সেখানেই থাকা উচিত। সেখানে বসে বাঙালি খানা ভাত ও মুরগির ঝোল খেয়ে তিনি অনায়াসে সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন।’

বাংলাদেশের চলতি রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে মাইলাম বলেন, কয়েক বছর ধরেই লক্ষ করা গেছে যে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে দেশটি ক্রমে একচেটিয়া মনোভাবের হয়ে উঠছে। ‘শেখ হাসিনা সম্ভবত দেশে একচেটিয়া শাসনব্যবস্থা চালুর পক্ষে। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো দলকে তিনি সহজে জায়গা ছেড়ে দেবেন না।’ মাইলাম অবশ্য স্বীকার করেন, শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বলেন, ‘এসব উন্নয়ন কাগুজে উন্নয়ন নয়, এর অনেক কিছুই প্রকৃত উন্নয়ন।’

মাইলাম মনে করেন, বাংলাদেশের এই অগ্রগতির আসল দাবিদার দেশের ব্যক্তিমালিকানা খাত। এই খাতকে সামনে এগোতে দিতে হাসিনার সরকার বাধা দেয়নি, এই কৃতিত্ব তাদের দিতে হবে। গত কয়েক বছরে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি রীতিমতো তাক লাগানোর মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি পোশাকশিল্প কারখানা ঘুরে দেখার সুযোগ তাঁর হয়েছে। মাইলাম বলেন, সেখানে যা দেখেছেন, তা তাঁর কাছে খুবই উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়েছে।

মাইলাম মনে করেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানা খাত যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, সামাজিক ক্ষেত্রে, বিশেষত নারী অধিকার, শিশুকল্যাণ ও শিক্ষা খাতে—ঠিক সেই রকম অগ্রগতি অর্জনে ভূমিকা রেখেছে দেশের বেসরকারি সাহায্য সংস্থাসমূহ।

মাইলাম হেসে বলেন, এখন অনেক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী তাঁর কাছে নিজের দেশের দুরবস্থা বর্ণনার সময় বাংলাদেশের উদাহরণ দেন। তাঁরা ঈর্ষার সঙ্গেই বলেন, ‘দেখুন, বাংলাদেশ কেমন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কেবল পিছু হটছি।’

এই সাফল্য সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কতটুকু জনপ্রিয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এর কারণ, মাইলামের মতে, দলটির নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অগণতান্ত্রিক মনোভাব। ‘এই বিপদের কথা আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। তথ্যমাধ্যমের ওপর যেভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তা থেকেই এই লক্ষণ ধরা পড়ে।’ মাইলাম মনে করেন, কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এই লক্ষণকে শক্তি জোগাচ্ছে।

মাইলাম মনে করেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, তুরস্ক ও ফিলিপাইনের মতো দেশেও এ ধারা প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মতো এসব দেশেও ‘কী করা যায়, সে বিষয়ে বিরোধী দলসমূহের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই’।
এই বর্ষীয়ান কূটনীতিক মনে করেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সাফল্যের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি সেই দল নয়। দেশে একটি তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক দল চাই, কিন্তু এই মুহূর্তে তেমন কোনো নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান তাঁর চোখে পড়ে না।

মাইলাম মনে করেন, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই। আজকাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা উঠলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা উগ্রবাদের উত্থানের কথা তোলেন। দেশে যদি গণতন্ত্রের চর্চা না থাকে, তাহলে উগ্রবাদের প্রসার সহজ হয়।

গণতন্ত্রের জন্য খারাপ খবর
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যানের সঙ্গেও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে। কুগেলম্যান মনে করেন, খালেদা জিয়ার বিচারের রায় ‘শুধু রাজনীতির জন্য খারাপ খবর নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্যও খারাপ খবর’। এক লিখিত মন্তব্যে কুগেলম্যান জানান, খালেদা জিয়া যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাবন্দী হন, তার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সূত্রপাত হতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে। এই দলের সমর্থকেরা সহিংস আন্দোলনের সূচনা করতে পারে, যার জবাবে সরকারও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

কুগেলম্যান মনে করেন, এই রায়ের মাধ্যমে যে বার্তাটি পাওয়া গেল, তা হলো বাংলাদেশ ক্রমে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে। ‘আজকের যে বাংলাদেশ তা কেবল নামেই গণতান্ত্রিক।’ তিনি বলেন, যে ছবিটি দেখা যাচ্ছে তা মোটেই সুন্দর নয়, কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হয় না।