লাথিতে তাঁর বজ্রশক্তি

মোহাম্মদ আনোয়ার কামাল ইউরি
মোহাম্মদ আনোয়ার কামাল ইউরি

ম্যাপল বা হিকোরি কাঠের বেসবল ব্যাট খুব শক্ত। এতটাই যে একটি বেসবল ব্যাট ভাঙতে লাগে ৭৪০ পাউন্ড ওজনের শক্তি। তাহলে তিনখানা বেসবল ব্যাট ভাঙতে কত শক্তি দরকার? সহজ ঐকিক নিয়মে ৭৪০ গুণিতক ৩ অর্থাৎ ২২২০ পাউন্ড।

আর তিনি মোহাম্মদ আনোয়ার কামাল ওরফে এম এ কে ইউরি কিনা ডান পায়ের জঙ্ঘাস্থির (শিন বোন) এক লাথিতেই মড়মড় করে ভেঙে ফেলেন তিনটি বেসবল ব্যাট! প্রায় অলৌকিক কাণ্ড। সন্ধান পেয়ে ডিসকভারি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশের এই শক্তিশালী মানুষটিকে নিয়ে যায় সুপারহিউম্যান শোডাউনে। ২০১৩ সালে ডিসকভারি চ্যানেলেই ইউরি দেখান অতিমানবীয় সেই পায়ের শক্তি। পেয়ে যান সুপারহিউম্যান বা অতিমানব খেতাব। বিশ্বের পাঁচ অতিমানবের একজন। তাঁর ডান পায়ের জঙ্ঘাস্থির একটি লাথির যে শক্তি, এই গ্রহের আর কারও তা নেই। সেই থেকেই খেতাব পান বজ্রপদমানব (থান্ডারশিনম্যান) বা বজ্রমুনি। রিপলির ‘বিলিভ ইট অর নট’ মিউজিয়ামে ঠাঁই পেয়ে গেছে ইউরির এক লাথিতেই তিনখানা বেসবল ব্যাট ভাঙার কীর্তি।

এই কীর্তি মার্শাল আর্ট ব্যুত্থান বা বজ্রপ্রাণচর্চার ফল। ইউরিই এটি উদ্ভাবন করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের মার্শাল আর্টরূপে। বাংলাদেশে যখন বেনোজলের মতো ধেয়ে আসছে চীনা, জাপানি, কোরীয় মার্শাল আর্ট, ইউরি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ব্যুত্থান নিয়ে পড়ে আছেন। একটি খেলার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ারও ব্রত নিয়েছেন।

ব্যুত্থান নামটিই বাংলা, সংস্কৃত থেকে গৃহীত বাংলা। মানে আন্দোলন। গালিচার ওপর দুজন প্রতিযোগী মুখোমুখি হলে আবহসংগীতে বাজে চিরায়ত বাংলার লাঠি খেলার বাদ্যি। ব্যুত্থানের সব পরিভাষাই বাংলা। যেমন ধ্যানপর্বে হাতজোড় করে বলতে হয় ভক্তি, প্রস্তুত বললে শুরু হয় খেলা। ‘মন চালা’ বলে ব্যুত্থানচারীরা চালায় পা (লাথি) এবং হাত (ঘুষি)। চীনা, জাপানি বা কোরীয় মার্শাল আর্টগুলোর সব পরিভাষাই কিন্তু বিদেশি।

কিশোর বেলায় বার্মিজ মার্শাল আর্ট ‘বান্ডো’ দিয়ে শুরু। সেই থেকেই মার্শাল আর্টের চিরপ্রেমিক ইউরি। ২০ বছর ধরে অর্ধশত দেশ ঘুরে ৪০টি মার্শাল আর্ট শিখেছেন, মার্শাল আর্টের ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ হয়েছেন। গেছেন খালি হাতে যুদ্ধকলার লালনস্থল চীনের হুনান প্রদেশের শাওলিন মন্দিরে। সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন মার্শাল আর্টের ভিত্তিভূমি ভারত। আর শাওলিন মন্দির বিকশিত হয়েছে প্রাচীন কাঞ্চিপুরমের (অধুনা চেন্নাইয়ের কাছে) রাজপুত্র বোধিধর্মার হাতে। রাজা সুগন্ধার পুত্র চীনের হুনানে গিয়েছিলেন ৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে।

বোধিধর্মায় অনুপ্রাণিত ইউরি ভাবলেন এমন একটি মার্শাল আর্ট করবেন, যেটি ধারণ করবে দক্ষিণ এশিয়া বা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। বান্ডোর সঙ্গে মেশালেন একই সঙ্গে লাথি ও ঘুষি চালিয়ে ভারতীয় আত্মরক্ষার কৌশল। নাম হলো ব্যুত্থান। নামটি দেন ভাষা আন্দোলন গবেষক বশীর আলহেলাল।

১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অ্যান্ডি স্কটকে সভাপতি এবং এম এ কে ইউরিকে মহাসচিব করে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ব্যুত্থান ফেডারেশন। ২০১০ ঢাকা দক্ষিণ এশীয় গেমসে ব্যুত্থানের বিশেষ প্রদর্শনী হয়। বাংলাদেশে সরকার স্বীকৃত ব্যুত্থান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকও ইউরি।

ডিসকভারি চ্যানেলের সুপারহিউম্যান শোডাউনের মাধ্যমে প্রায় ২০০ দেশে ব্যুত্থানের কলাকৌশল দেখানো হয়। কৃতিত্ব ইউরির। ব্যুত্থানের ধ্যান, বজ্রপ্রাণ সম্পূরক ব্যায়াম, বিচক্ষণতা ও আত্মজ্ঞান কাজে লাগিয়ে যিনি পায়ে অমিত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন। তাতেই একসঙ্গে তিনখানা বেসবল ব্যাট ভেঙে ফেলতে পারেন এক লাথিতে। ডিসকভারির বিশেষজ্ঞদের গবেষণা দেখিয়েছে, ইউরি তাৎক্ষণিকভাবে নিজের মস্তিষ্ককে তুলে নিতে পারেন আলফা স্তরে। মাংসপেশির শতকরা ৯৬ ভাগ কাজে লাগাতে পারেন, যেটি বিশ্বের আর কোনো মানবসন্তান পারেনি।

সম্প্রতি ঢাকার মহাখালীতে ইউরির অফিসে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কিছুদিন আগে এসেছেন ব্রুনাই থেকে। কদিন পর যাবেন ভুটানে, যুক্তরাষ্ট্রে। বললেন, ব্যুত্থানকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করতেই ছুটে বেড়ান দেশ-দেশান্তরে।

মামা নাম রেখেছিলেন ইউরি, ইতিহাসের প্রথম নভোচারী রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিনের নামের সঙ্গে মিল রেখে। মামা ভেবেছিলেন ভাগনে ভবিষ্যতে অভিযাত্রী হলেও হতে পারে। তা ইউরি অভিযাত্রীই হয়েছেন! একটি মার্শাল আর্টের রঙে বিশ্বমানচিত্রে দুঃসাহসে এঁকে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ছবি।

কাঁধ ছড়িয়ে পড়া চুল। যোগী চেহারার ইউরির উচ্চতা ৫ ফুট সাড়ে ৬ ইঞ্চি। ওজন ৭২ কেজি। অনেকেই জানেন না গড়পড়তা শরীরের এই বাঙালিই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পায়ের অধিকারী। লাথিতে যাঁর বজ্রশক্তি, উৎস ব্যুত্থান নামের আত্মরক্ষামূলক খেলা।