এই সংগ্রামের কথা অনেকে জানেন না

সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪—১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪—১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কোথায় কলকাতা আর কোথায় তখনকার বগুড়া। তুলনাই হয় না। তবু শেষ পর্যন্ত কিসের টানে কলকাতার শহুরে জীবন ছেড়ে পঞ্চাশের দশকের একমুঠো আয়তনের শহরে চলে এসেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী? ভালোবাসার টানে তো অবশ্যই। যে ভালোবাসা তাঁকে বিপদেও ফেলেছিল। যে গল্পটা আমাদের অনেকেরই অজানা।

বগুড়া শহরটায় খুব বেশি দিন থাকা হয়নি মুজতবা আলীর। তবু তাঁর জীবনের বেশ কিছু বড় ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শহর। এখানে থাকার সময়ই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখক জীবনের সেরা সৃষ্টি ‘দেশে বিদেশে’। ‘দেশে বিদেশে’–র তুলনায় আয়তনে খুবই ছোট একটা বই, যাকে পুস্তিকা বলেই চেনানো হয়, সেই বইটার কারণে মুজতবা জড়িয়ে গিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের শুরুর সেই দিনগুলোর সঙ্গে।

সরাসরি না হলেও নিজের কলম দিয়ে সে সময় বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় পণ্ডিতদের একজন লড়াই করেছিলেন মাতৃভাষার হয়ে। মায়ের মুখের ভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার পুণ্যময় কাজের তুলনায় কোনো অংশে কম ছিল না এই যুক্তির লড়াই। যে কারণে নিগ্রহের স্বীকার হতে হয়েছে মুজতবা আলীকে। হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছে তাঁর পরিবারকেও। ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামের সেই বইটির প্রতি পরতে অকাট্য যুক্তি দিয়ে মুজতবা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এই বাংলায় উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া হবে বোকামি। তা কখনোই সফল হবে না। ১৯৪৯ সালে প্রবন্ধ আকারে বইটি প্রথম প্রকাশিত হলেও এই বক্তব্য তিনি প্রথম উপস্থাপন করেন ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর। সিলেটের এক সাহিত্য সভায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই বয়স তখন তিন মাসও হয়নি।

পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হওয়া উচিত, শুরু দিকে জোরালো বক্তব্য দিয়ে যাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন, মুজতবা আলী এঁদের একজন। দুই বছর পরে আরও বড় আকারে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলে তা ভাষা আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিল সন্দেহ নেই।

বন-বার্লিন-কায়রো ঘুরে আসা যাযাবর মুজতবা আলীকে বগুড়ায় টেনে এনেছিল এখানকার মানুষের ভালোবাসা। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে আজিজুল হক কলেজের বার্ষিক সাহিত্য সম্মিলনীর সভাপতি হিসেবে এ শহরে আসেন। তখন তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী ছিলেন বগুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট (সে সময় ম্যাজিস্ট্রেটই ছিলেন প্রশাসনিক প্রধান)। এখানে দুদিন তিনটি সভায় মজলিশি মেজাজে রসবোধ ও পাণ্ডিত্যের মিশেলে দুর্দান্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন। সে সময় ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। অনুরোধ করেছিল বগুড়ায় থেকে যাওয়ার জন্য। এই কলেজ থেকে তখন মাত্রই বিদায় নিয়েছিলেন ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনিই যাওয়ার সময় সুপারিশ করে যান, কলেজের পরবর্তী অধ্যক্ষ হিসেবে মুজতবা আলীর কথা তাঁরা ভাবতে পারে।

মুজতবা আলী তখনো সংসার শুরু করেননি। কোথাও থিতু হওয়ার মানুষই তিনি ছিলেন না। পায়ের তলায় সরষে ছিল তাঁর। পৃথিবীর পাঠশালায় ঘুরে ঘুরে জীবনের ধারাপাত পড়তে চেয়েছিলেন ভীষণ। কিন্তু শেষে মত বদলান। কলকাতা থেকে চলে আসেন আধশহুরে বগুড়ায়। বড় ভাই মুর্তাজার প্রতি অন্য রকম টান ছিল। জার্মানিতে পড়ার সময় এই বড় ভাই প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে পাঠিয়েছিলেন। সেই সময়ের হিসাবে টাকাটা অনেক বড়। ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা তো ছিলই, বগুড়ার মানুষের ভালোবাসাও ভুলতে পারেননি।

কিন্তু শুরু থেকেই বিপত্তি। কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পর প্রথম যে নিয়মটা তিনি করেন, শিক্ষকদের নিয়ম অনুযায়ী কলেজে আসতে ও যেতে হবে। যে অধ্যাপকেরা খেয়াল–খুশিমতো যাওয়া আসা করতেন, শুরুতেই তাঁরা পড়লেন বিপদে। আরেকটা ঝামেলা বাধল। ছাত্রসংসদ নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল মুসলিম লিগের অনুসারী ছাত্রসংগঠন। তারা অধ্যক্ষের ওপরে চাপ তৈরি করল নির্বাচন বাতিলের। না হলে মুজতবা আলী বিপদে পড়বেন বলেও শাসিয়ে গেল। কিছুতেই লাভ হচ্ছে না দেখে পরাজিত ছাত্রনেতারা ঢাকায় গিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দেনদরবার করল।

মুজতবা আলী আগে থেকেই তাঁর লেখার কারণে প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্ষুশূল ছিলেন। এদের অনেকে বগুড়ায় তাঁকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগে নাখোশ হন। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালের আগস্টে বিশদ আকারে প্রকাশিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে সিলেটে দেওয়া তাঁর বক্তব্য। এবার মুজতবাকে কোণঠাসা করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় আজিজুল হক কলেজের সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধকে। যেখানে মন্ত্রীদের কটাক্ষ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সরকারি চাকরি করে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় মুজতবাকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

মুজতবা সে সময় ছিলেন ভাইয়ের সরকারি বাসভবনে। কলেজ অধ্যক্ষের জন্য কোনো বাসভবনও ছিল না। তাঁর বড় ভাই মুর্জাতাকেও জড়ানো হয়। পরিস্থিতিকে সুবিধাবাদীরা নানাভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে দেখে মুর্তাজা ঢাকায় এসে মুখ্য সচিব আজিদ আহমেদকে বলেন, ‘দেখুন, আমার ভাই ১৭ বছর আগে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছে। বগুড়ার মতো ছোট শহরে চাকরির জন্য সে আর মুখিয়ে নেই।’ তাঁর ভাইয়ের যে মেধা ও প্রজ্ঞা, সে সময় খুব কম মানুষেরই তা ছিল। নবগঠিত একটা দেশ যে মুজতবা আলীর মেধা কাজে লাগাচ্ছে না, উল্টো ষড়যন্ত্র করছে, এ নিয়ে হতাশার শেষ ছিল না মুর্তাজা আলীর।

সরকার মুর্তাজা আলীর কথাও শোনেনি। উল্টো তাঁকেও একপদ নিচে নামিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট করে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল চট্টগ্রামে। নিজের পরিবারকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করতে মুজতবা আলী আবার ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যাপক হিসেবে। এ সময় ভারতের শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁকে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস বিভাগে কাজ করার জন্য দিল্লিতে ডেকে নেন।

তবে সিলেটে জন্ম নেওয়া মুজতবা, বোহেমিয়ান এই বাংলার প্রতি তাঁর শেকড়ের টান কখনো ভোলেননি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দূরে বসেও নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। নিজে ১৫-১৬টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তিনি ছিলেন সে সময়ের জীবন্ত গুগল যেন! নিজের লেখায় ফারসি থেকে ফরাসি ব্যবহার করেছেন সাবলীলভাবে। কিন্তু এত ভাষা জেনেও বাংলাকে কখনো ভোলেননি। বরং বাংলার জন্য লড়াই করেছেন।

পাকিস্তানের নাগরিকত্ব কোনোভাবেই গ্রহণ না করলেও দেশ স্বাধীনের এক মাস পর বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। বৈবাহিক সূত্র ছাড়া ঢাকার সঙ্গে তাঁর আত্মার বন্ধন সেভাবে তৈরি হওয়ার হয়তো সুযোগই হয়নি। অথচ এখানেই ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মারা গেলেন। ঢাকাতেই দাফন করা হয়েছে তাঁকে।

মুজতবা তাঁর ‘দেশে বিদেশে’–র একটি অংশে হিন্দুস্তানে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করা সম্রাট বাবর কেন কাবুলে সমাধি বেছে নিয়েছিলেন, তার আবেগময় সরল বর্ণনা দিয়েছিলেন: ‘খোলা আকাশের নিচে কয়েক ফালি পাথর দিয়ে বানানো অত্যন্ত সাদাসিধে কবর। মোগল সরকারের নগণ্যতম মুহুরির কবরও হিন্দুস্তানে এর চেয়ে বেশি জৌলুশ ধরে।’ এই সাদামাটা কবর থেকে বাবর তাঁর পুরো সাম্রাজ্যকে দেখতে চেয়েছিলেন কাবুলের ওই পাহাড় থেকে।

কে জানে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী ঢাকাকেও মুজতবা আলী বেছে নিয়েছিলেন কি না একই কারণে!

তথ্যসূত্র: মুজতবা কথা; লেখক সৈয়দ মুর্তজা আলী ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ রেজা আলী।