শহীদদের অভিপ্রায় আমাদের ঔদাসীন্য

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

আবার এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি।

১৯৫২ সালের এই দিনে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা আমাদের চেতনায় জাতীয়তাবাদী ভাবধারাই রোপণ করেছিলেন। আমার মনে হয় না, কেউ তখন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কথা ভেবেছিলেন। তবে মর্যাদার সঙ্গে, নিজেদের সকল রকম অধিকার আদায় করে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলা ভাষা, হরফ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যতই আক্রমণ এসেছে, বাঙালিত্বের গৌরববোধ ততই প্রবল হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন, বিভিন্ন ঋতুবরণ, নববর্ষ পালন, রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের বলে দাবি—এসবই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশের নিদর্শন। এর পাশাপাশি পূর্ব বাংলার মানুষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছিলাম।

আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এই বিধানে একুশে ফেব্রুয়ারির মূল দাবি নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এত বছর পরও জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলিত হয়নি। এ জন্য আমাদের ঔদাসীন্য অনেকখানি দায়ী। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কয়েক বছরে বাংলা উচ্চশিক্ষার বইপত্র লেখার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে বাংলায় প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্বানেরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলায় বইপত্র লিখতে আর এগিয়ে আসেননি। ইংরেজি বই পড়ে বাংলায় পড়ানো এবং প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সামর্থ্যও আমরা অর্জন করিনি। ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বিঘ্নিত হয়ে আছে এবং ইংরেজি পাঠ মুখস্থ করার প্রবণতা সর্বত্র দেখা দিচ্ছে। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রবেশাধিকার এখনো সীমিত। সুতরাং একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সত্ত্বেও শহীদেরা যে দাবির জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন, তা আজও অপূর্ণ রয়ে গেল।

আমরা কি আশা করতে পারি যে কেবল মুখের কথা নয়, কাজের মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হব?