সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখে বাংলা ভাষার অনুরাগী

কাজুহিরো ওয়াতানাবে অনূদিত বই
কাজুহিরো ওয়াতানাবে অনূদিত বই

চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবি পথের পাঁচালী দেখে চোখ ছলছল হয়ে উঠল এক জাপানি তরুণের। তাঁর নাম কাজুহিরো ওয়াতানাবে। গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকের ঘটনা এটা।

অনেকের মনে হতে পারে, এ আর এমনকি, সিনেমা দেখে তো অসংখ্য লোক কেঁদেছেন, কাঁদেন। তবে সত্যজিতের এই ছবিটি ওয়াতানাবের হৃদয়ের গভীরে যে কী রকম প্রভাব রেখেছিল, তাঁর প্রমাণ আমরা পেয়েছি পরবর্তী সময়ে। বলা যায়, একটি ছবিই ঘুরিয়ে দিয়েছে ওয়াতানাবের জীবনের গতিপথ। বাংলা ভাষার প্রেমে পড়ে রীতিমতো বঙ্গপ্রেমিক হয়ে উঠলেন এই জাপানি। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে পথের পাঁচালী দেখে কেঁদেছিলেন ওয়াতানাবে, কিন্তু তখন কি শুধুই তিনি কেঁদেছিলেন?

না। ‘কেঁদেছিলেন’ বললে সবটা বলা হয় না। বাংলা ভাষা তখন তাঁর কাছে প্রায় অজানা থাকলেও এ ভাষার মাধুর্য ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। সেই তো শুরু। নতুন স্বাদ পাওয়া বাংলা ভাষার মাধুর্য নিয়ে আরও বেশি করে জানাবোঝার ভাবনা তাঁর মাথায় খেলে গিয়েছিল তখন থেকেই।

সারা বিশ্বে হাতে গোনা যে কয়েকজন বিদেশি নিষ্ঠার সঙ্গে এখন বাংলা ভাষা চর্চায় নিয়োজিত, নিঃসন্দেহে জাপানি নাগরিক কাজুহিরো ওয়াতানাবে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উপরন্তু তিনি হচ্ছেন সেই বিলুপ্তপ্রায় বিদেশিদের একজন, যিনি বাংলা ভাষায় লেখালেখির মধ্য দিয়ে বঙ্গভাষীদের কাছে নিজের দেশের অজানা অনেক তথ্য তুলে ধরার কাজও করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

কাজুহিরো ওয়াতানাবের জন্ম ১৯৫২ সালে, জাপানের নাগোইয়া জেলায়। সত্তরের প্রথমার্ধে যে সময় পথের পাঁচালী দেখেছিলেন, সে সময় তিনি ছিলেন টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি ভাষার ছাত্র। বলার বিষয় হলো, সত্যজিতের ছবিই যে হিন্দি থেকে ক্রমেই তাঁকে টেনে এনেছে বাংলা ভাষার দিকে, এ নিয়ে সরল স্বীকারোক্তি ওয়াতানাবে নিজেরই আছে: ‘সত্যজিৎ রায়ই আমাকে বাংলার দিকে নিয়ে এসেছেন। মূলত তাঁর কারণেই বাংলা নামের মিষ্টি এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি আমি।’

সত্তরের দশকে টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল ভাষা হিসেবে বাংলা নিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না। তবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা সেখানে পড়াচ্ছিলেন অধ্যাপক ৎসুইয়োশি নারা। বাংলাদেশে যাঁরা বিদেশে বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, অধ্যাপক নারা তাঁদের অনেকের কাছেই পরিচিত। সত্তরের শুরুতে বছর দু-এক তিনি বাংলাদেশেও কাটিয়ে গেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে জাপানি ভাষার শিক্ষক হিসেবে।

তো, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ থাকায় আর কালবিলম্ব করলেন না কাজুহিরো ওয়াতানাবে, অধ্যাপক নারার বাংলা ভাষার ক্লাসে যোগ দিতে শুরু করেন তিনি। বিস্ময়ের কথা হলো, কাগজে-কলমে দ্বিতীয় ভাষা হলেও অচিরেই বাংলাই হয়ে ওঠে ওয়াতানাবের সাধনা আর প্রেরণার ভাষা। এরপর থেকে সারা জীবন নিজেকে তিনি জড়িয়ে রেখেছেন বাংলা ভাষা চর্চার সঙ্গে। বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন পরম নিষ্ঠায়। শুধু তা-ই নয়, আরও ভালোভাবে বাংলা ভাষা রপ্ত করার জন্য বছরখানেক ছিলেন শান্তিনিকেতনেও।

জাপানে যাঁরা সেই সময় বাংলা ভাষা শিখেছেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতে গোনা। এর মূল কারণ অবশ্যই ভাষা শেখার পর সেই ভাষা নিয়ে কাজ করতে পারার সুযোগের অভাব। একদিক থেকে ওয়াতানাবেকে কিছুটা ভাগ্যবানই বলতে হবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করার পর বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পরবর্তী জীবনে চাকরি সূত্রে পেয়েছেন তিনি।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে জাপানের নাগরিক সম্প্রচার কেন্দ্র এনএইচকে-এর বাংলা বিভাগে চাকরি পান ওয়াতানাবে। আর তখন থেকে বাংলা হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের আরও কাছের এক ভাষা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ভাষায় তিনি প্রতিদিন কাজ করে গেছেন আর কাজের সূত্রে বাংলাকে আরও নিবিড়ভাবে জানা-বোঝার সুযোগও ঘটেছে। রেডিওতে কাজ করার কল্যাণে বাংলা উচ্চারণের শুদ্ধতাও রপ্ত করতে পেরেছিলেন। ফলে ওয়াতানাবে যখন হঠাৎ অপরিচিত কোনো বঙ্গভাষীর সঙ্গে বাংলায় আলাপ করেন, অবাক হতে হয় এই ভেবে যে একজন বিদেশি এত সুন্দরভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলছেন!

রেডিও জাপানে দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় কাজ করার পর কিছুদিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে গেছেন ওয়াতানাবে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি টান এখনো এনএইচকের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে তাঁকে। জাপানি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের কাজেও নিজেকে বেশ ভালোভাবেই জড়িত রেখেছেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। জানা মতে, আরও কিছু অনুবাদ নিয়ে এখন তিনি কাজ করে চলেছেন।

কাজুহিরো ওয়াতানাবের উল্লেখযোগ্য দুটি অনুবাদ বই হলো জাপানের প্রয়াত রাজনীতিবিদ তাকেশি হায়াকাওয়ার আমার বাংলাদেশ এবং তাদামাসা হুকিউরার ১৯৭১-এর স্মৃতি রক্ত ও কাদা ১৯৭১। দুটি বই-ই বের হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। তবে কেবল জাপানি থেকে বাংলা ভাষায় নয়, বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। বছর দু-এক আগে তাঁর অনুবাদে জাপান থেকে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী। আর কিছুদিন আগে শেষ করেছেন ১৯৭৭ সালে জাপান এয়ারলাইনসের বিমান ছিনতাই করে ঢাকায় নিয়ে আসা এবং সেই সময়ের ঘটনাবলি নিয়ে জাপানের সাবেক মন্ত্রী হাজিমে ইশির জাপানি ভাষায় লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদের কাজ। শেষ করেছেন রাসবিহারী বসুর ওপর জাপানে লেখা একটি বইয়ের অনুবাদও। এ বই দুটি এ বছর কোনো একসময়ে যথাক্রমে ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হবে বলে জানালেন ওয়াতানাবে।

বাংলা ভাষা নিয়ে কেবল রেডিওর দৈনন্দিন কাজ আর অনুবাদের মধ্যেই নিজেকে সীমিত রাখেননি ওয়াতানাবে। ২০১২ সালে টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার নিয়মিত কোর্স চালু হলে সেখানে যোগ দিয়েছেন শিক্ষকতার কাজে। ভবিষ্যতেও জাপানে যেন বাংলা ভাষার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা তারুণ্যের বিকাশ নিশ্চিত করা যায়, সেই চিন্তা প্রতিনিয়তই কাজ করে তাঁর মাথায়। ওয়াতানাবে বলেন, আমার শিক্ষকতায় আসার পেছনেও আছে বাংলা ভাষা, জাপানে আমি বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে চাই।

সন্দেহ নেই এমন এক বাংলা ভাষা প্রেমিক বিদেশিকে নিজেদের একজন হিসেবে পাওয়া আমাদের জন্যও হচ্ছে দুর্লভ এক প্রাপ্তি।

কাজুহিরো ওয়াতানাবে
কাজুহিরো ওয়াতানাবে

কাজুহিরো ওয়াতানাবে,জাপান

জন্ম: ১৯৫২

উল্লেখযোগ্য বই

তাদামাসা হুকিউরার লেখা ১৯৭১-এর স্মৃতি রক্ত ও কাদা ১৯৭১ (জাপানি থেকে বাংলায় অনুবাদ)

তাকেশি হায়াকাওয়ার লেখা আমার বাংলাদেশ (জাপানি থেকে বাংলায় অনুবাদ)

শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী (বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ)