জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়: 'কল্পকাহিনি' সাজিয়ে অর্থ আত্মসাৎ

কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে পেশ করা কুয়েতি দূতাবাসের সাফাই চিঠি, জমি কেনার বায়নাপত্র ও টাকার মোকদ্দমাকে ‘জাল, সৃজিত ও কল্পকাহিনি’ বলেছেন বিশেষ আদালতের বিচারক ড. আক্তারুজ্জামান। মামলার রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালে ‘প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের’ নামেই ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা এসেছিল। অথচ খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে এই অর্থ দেওয়া হয়েছে বেসরকারিভাবে, সরকারি তহবিল গঠনের জন্য নয়।
বিশেষ আদালত ৬৩২ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলেছেন, এই দুর্নীতির ঘটনায় মোট ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। আর তাতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তারেক রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগনে মোমিনুর রহমান, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী সালিমুল হক কামাল এবং যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। খালেদা জিয়া ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ এবং তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী ‘সরকারের আর্থিক নিয়মকানুন-সংক্রান্ত বিধিবিধানের বরখেলাপ করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা’ করার দায়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত হয়েছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালত ৮ ফেব্রুয়ারি ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনকে দণ্ডিত এবং প্রত্যেককে আত্মসাৎ করা সমপরিমাণ টাকা সমহারে জরিমানা করেছেন।
আসামি খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে টাকা তুলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখায় তা বেড়ে প্রায় ৬ কোটি টাকা হয়েছে। বিশেষ আদালত তাঁর রায়ে এই দাবি নাকচ করে বলেছেন, সঞ্চিত টাকা থেকে আত্মসাৎ না করলে এ টাকার পরিমাণ আরও বাড়ত। তা ছাড়া ঘোষিত লক্ষ্যে ব্যবহার না করে অনির্দিষ্টকাল টাকা ফেলে রাখাও অপরাধ।
রায়ের বিবরণে আছে, প্রধানত সচিব কামাল সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের নামে কুয়েত থেকে আসা অর্থ সোনালী ব্যাংকের রমনা
শাখা হিসাবে গচ্ছিত রাখা এবং দুই বছর পর ১৯৯৩ সালে তা দুই ভাগ জিয়া মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের হিসাবে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার ‘যোগসাজশ’কে শাস্তিযোগ্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টাকা গ্রহণ করায় তা সরকারি টাকায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে পাওয়া এ অনুদান তিনি দাতার কাছে ফেরত দিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজের নামে বগুড়ায় কেনা প্রায় ৩ একর জায়গা এখনো ধানি জমি হিসেবে পড়ে আছে। তাই তিনি যে ‘কোনো আইন লঙ্ঘন’ করেননি, সে বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।

খালেদা জিয়ার অনিয়ম সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়া এতিম তহবিলের কাস্টডিয়ান হয়েও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দুটি চেকের মাধ্যমে ট্রাস্টদ্বয়ের প্রতিটি ট্রাস্টকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা প্রদান করেছিলেন। সরকারি এতিম তহবিলের টাকা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়ে অন্যায়ভাবে অন্য দুটি প্রাইভেট ট্রাস্টের অনুকূলে হস্তান্তর করা সঠিক হয়নি। কাজেই আসামির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে প্রতীয়মান হয়।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠিত হয়েছিল কেবলই তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় মোমিনুর রহমানকে নিয়ে। এই ট্রাস্টে ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে সেই অর্থ স্থানান্তরের আগে হিসাবটিতে কোনো টাকা ছিল না। সে অর্থ কীভাবে ‘আত্মসাৎ’ করা হয়েছে, তা-ই ছিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার মূল বিচার্য।
কুয়েত ওই টাকা সরকারিভাবে দেয়নি, কেবল জিয়া অরফানেজকে দিয়েছিল—খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য আদালত নাকচ করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে আদালতে পেশ করা দূতাবাসের একটি পত্রে বলা হয়েছিল, কুয়েত ওই টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দিয়েছে। আদালত চিঠিটিকে ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে গতকাল বুধবার বলেন, তাঁদের দেওয়া দলিলকে জাল হিসেবে মন্তব্য করার জন্য রায়দানকারী বিচারকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী যথাব্যবস্থা নিতে তাঁরা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন। তাঁর কথায়, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীকে কুয়েত দূতাবাসের লেখা মূল চিঠি তাঁদের কাছে আছে। সময়মতো তাঁরা সেটি উচ্চ আদালতে পেশ করবেন। একে জাল বলায় আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অপমান করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের মানহানি ঘটেছে।

সৃজিত কল্পকাহিনি
আদালতের রায় অনুযায়ী ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের আশুলিয়ার জমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য কথাবার্তা হয়। সে বছরই একটি চুক্তির আওতায় তিনি সোয়া ২ কোটি টাকা অগ্রিম নেন। ২০০৭ সালের ৩১ মের মধ্যে জমি বিক্রির দলিল সম্পাদনের তারিখ থাকলেও তা হয়নি। শরফুদ্দিন আহমেদ আদালতকে এ তথ্য দিয়ে আরও বলেন, ‘২০১২ সালের জানুয়ারিতে একটি টাকার মোকদ্দমা মামলায় আমি নোটিশপ্রাপ্ত হই যে ট্রাস্টকে ওই টাকা ফেরত দিতে হবে। আদালত ওই সোয়া ২ কোটি টাকা ২০১৩ সালে এক সোলেনামার ভিত্তিতে ফেরত দিতে ডিক্রি জারি করেন। এরপর আমি প্রাইম ব্যাংক নিউ ইস্কাটন ও গুলশান শাখা থেকে ১৩টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ট্রাস্টকে হস্তান্তর করি।’
বিচারক তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন, ওই ব্যক্তির বায়না করা সাড়ে ৭৪ শতক জমি ছিল বলে প্রমাণ মেলেনি। অর্থও সোনালী ব্যাংকের বদলে তিনি উত্তরা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন, যেখানে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কোনো হিসাব ছিল না। অন্য আসামি কাজী সালিমুল হক প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে সোনালী ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ আসামি তারেক রহমান ও মোমিনুর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রাইম ব্যাংকে নিয়ে আসেন। এরপর নানা কৌশলে প্রথমে নিজে কিছু টাকা আত্মসাৎ করেন, পরে আসামি শরফুদ্দিন আহমেদকে সরাসরি সহায়তা করেন।
এরপর বিচারক লিখেছেন, ওই লেনদেনে তারেক রহমান ও মোমিনুর রহমানের যৌথ স্বাক্ষর করা পাঁচটি চেক পাওয়া গেছে। কাজী কামাল নিজেই বলেছেন, ‘এই টাকা যে জনাব তারেক রহমানের নিজস্ব টাকা কিংবা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা বা অন্য কারও টাকা, বর্ণিত পাঁচটি চেক দেখে বোঝার উপায় ছিল না।’ বিচারক লিখেছেন, ‘কাজী কামালের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য থেকে দেখা যায়, তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের হিসাব হতে ইস্যু করা পাঁচটি চেক থেকে এফডিআর করেন এবং তা আসামি তারেক রহমানকে বুঝিয়ে দেন।’ এ থেকে পরিষ্কার যে আসামি কাজী কামালের হাত হয়ে সরকারি এতিম তহবিলের টাকা আসামি তারেক রহমানের হাতে চলে যায়। সরকারি টাকা আত্মসাতের দায় তাই আসামি তারেক ও কাজী কামাল এড়াতে পারেন না। আদালত মনে করেন, যৌথ স্বাক্ষরে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করায় আসামি তারেকের সঙ্গে মোমিনুর রহমানও ‘সম্ভবত দায়ী’।
বিচারক আরও বলেন, আসামি শরফুদ্দিন আহমেদ ট্রাস্টের কাছে ৭৫ দশমিক ৫ শতক জমি বিক্রি না করেও আসামি কাজী সালিমুল হক ও জনৈক গিয়াসউদ্দিনের (শরফুদ্দিনের বড় ভাই) মাধ্যমে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ‘দুষ্ট মন নিয়ে’ নিজ হিসাবে জমা করেছেন। পরে ট্রাস্টের সঙ্গে ভুয়া টাকা মোকদ্দমা ও মিথ্যা সোলেনামা দাখিল করে এবং মিথ্যা কল্পকাহিনি সৃষ্টি করে তথাকথিত বায়নার টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে জমা দেওয়ার মিথ্যা কাহিনি রচনা করেছেন।
বিচারক বলেন, এটা প্রমাণিত যে ‘আসামি বেগম খালেদা জিয়াসহ অপরাপর আসামিগণ পরস্পর যোগসাজশে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে বা অন্যকে অবৈধভাবে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি এতিম তহবিলের অর্থ নামসর্বস্ব জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে স্থানান্তর করেন কিংবা করার কাজে সহায়তা করেন এবং সে কারণে তাঁরা সকলেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।’ আদালত মনে করেন, ছয় আসামির প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন। এ কারণে তাঁরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধীও বটে।
আদালত বলেছেন, দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় আসামিকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সশ্রম বা বিনাশ্রম দণ্ডের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু লেখা নেই। সেখানে শুধু ‘ইমপ্রিজনমেন্ট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ অবস্থায় সব আসামিকে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
‘ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি’, খালেদা জিয়ার মৌখিক বক্তব্যের এ উল্লেখটিকে বিচারক তাঁর রায়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি’—এই বাক্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বাদ পড়েছে। তবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সে বক্তব্য দিয়েছেন কার্যবিধির ৩৪২ ধারায়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এমন নজির ভূরি ভূরি আছে, যেখানে বলা হয়েছে, এ ধারার আওতায় আসামির বিরুদ্ধে তাঁর দেওয়া বক্তব্যকে ব্যবহার করা যাবে না।

কুয়েত দূতাবাসের পত্র
২০১৫ সালের ১১ আগস্ট সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীকে ঢাকার কুয়েত দূতাবাসের দেওয়া এক পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘উক্ত অনুদান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দেওয়া হয়েছিল এবং তা কোনো ব্যক্তি কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়নি।’
দূতাবাস তাদের এই পত্রকে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিল। বিচারক তাঁর রায়ের ৫৪৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, আদালতে ‘কেন ওই পত্রের ফটোকপি এবং কেন কুয়েত দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তাকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে এনে ওই পত্রের সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়নি?’ এরপর বিচারক লিখেছেন, ‘ওই সার্টিফিকেটে বলা হয়েছে যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে কুয়েত সরকার অনুদান দিয়েছে। কিন্তু এটা উল্লেখ করা হয়নি যে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার (৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা) জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে প্রদান করা হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে এতিমখানা খোলার জন্য দেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়নি।’
বিচারক লিখেছেন, ‘ওই পত্রে শুধু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে এই মামলার আসামি খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের বাঁচানোর লক্ষ্যে কুয়েত এমবাসি প্রদত্ত পত্রটি সৃজন করা হয়েছে।’
হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চে আজ বৃহস্পতিবার এই মামলার আপিল আবেদন গ্রহণ করা বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন, হাইকোর্ট শুনানির আবেদন গ্রহণ করলে সেখানে কুয়েত দূতাবাসের চিঠির সত্যতা যাচাই করা হয় কি না, তা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হয়ে উঠতে পারে।