'এ প্লাসের' নিশ্চয়তা দেয় তারা

উত্তরখানে চারতলা ভবনে তিনটি কক্ষ নিয়ে ক্যামব্রিজ হাইস্কুল। একই ভবনে রয়েছে স্কলাসটিকা নামে আরেকটি স্কুল।  প্রথম আলো
উত্তরখানে চারতলা ভবনে তিনটি কক্ষ নিয়ে ক্যামব্রিজ হাইস্কুল। একই ভবনে রয়েছে স্কলাসটিকা নামে আরেকটি স্কুল। প্রথম আলো

ঢাকার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে বালু নদের তীর ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম কাঁচকুড়া। বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে গ্রামটির দূরত্ব আট কিলোমিটার। রাস্তাটা ভাঙা, ধুলায় ভরা।
কাঁচকুড়া যেতে রাস্তার দুই পাশের দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটিতে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চোখে পড়বে। মাথার ওপরেও ব্যানার টানানো। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয়েছে ক্যামব্রিজের মতো খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিল রেখে। আবার স্থানীয় গণ্যমান্য বা তাঁদের মা-বাবার নামেও আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছাত্র ভর্তি করা হচ্ছে এ প্লাস পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে তাদের শিক্ষার্থীদের শতভাগ এ প্লাস প্রাপ্তির কথা।
‘কাঁচকুড়া ক্যামব্রিজ হাইস্কুল’ নামে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ দুই শিক্ষক এবং সৃজনশীল কোচিং সেন্টারের দুই শিক্ষককে গত সোমবার গ্রেপ্তার করেছে র্যা ব-৩। তাঁরা হলেন কাঁচকুড়ার ক্যামব্রিজ হাইস্কুল নামের একটি বেসরকারি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তানভীর হোসেন (২৯) ও সহকারী শিক্ষক সজীব মিয়া (২৬) এবং একই এলাকার সৃজনশীল নামের একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক মো. ইব্রাহিম (২১) ও এনামুল হক (২৭)। গ্রেপ্তার আরেকজন হাসানুর রহমান (২৯) অনলাইনে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিক্রি করতেন বলে অভিযোগ।
র্যা ব বলছে, এই শিক্ষকেরাই তাঁদের ছাত্রদের জন্য ফাঁস হওয়া এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী) প্রশ্ন কিনে সেটি চটজলদি সমাধান করতেন বা সমাধানসহ ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনতেন। এরপর সেগুলো ছাত্রদের মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষার হলে পাঠানো হতো। এ জন্য অভিভাবকেরা শিক্ষকদের বিশেষ তহবিল দিয়েছেন।
ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কেনার জন্য অভিভাবকদের তহবিল গঠনের বিষয়টা ছিল অনেকের কাছেই বড় ধাক্কার মতো। বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে মঙ্গলবার কাঁচকুড়ায় যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়ে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় বড় বিজ্ঞাপন। ক্যামব্রিজের নামটা যেহেতু মঙ্গলবার শোনা হয়ে গেছে, তাই চোখে সেই নামটিই হয়তো বেশি পড়ছিল। দোবাদিয়া বাজার পার হওয়ার পরে প্রায় প্রতিটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে সাদার ওপর লাল রঙে বড় করে ক্যামব্রিজ লেখা। এত এত বিজ্ঞাপন দেখে ধারণা হলো, হয়তো অনেক বড় বিদ্যালয়। কিন্তু শেষতক দেখা গেল, কাঁচকুড়া বাজারের একটি চারতলা ভবনের ঘুপচি ঘরে কয়েকটি বেঞ্চ-টেবিল দিয়ে বিদ্যালয় সাজানো হয়েছে।
কাঁচকুড়া গ্রামটি ঘনবসতিপূর্ণ নয়। কয়েকটি পোশাক কারখানা আছে। কারখানার শ্রমিকেরা আশপাশে থাকেন। বাকিরা স্থানীয়। কাঁচকুড়া বাজারের ওপর দিয়ে রাস্তাটা গেছে বালু নদের পাড় পর্যন্ত। ঢাকার কাছে হয়েও যাতায়াতের সমস্যা এলাকাটিকে প্রত্যন্ত করে রেখেছে। বাজারের সাঈদ কমপ্লেক্স নামের চারতলা ভবনের দোতলা ও তিনতলায় তিনটি কক্ষ নিয়ে ক্যামব্রিজ হাইস্কুল। একই ভবনে স্কলাসটিকা নামের আরেকটি স্কুল চলছে। চারতলা ওই ভবনের নিচতলায় রয়েছে সেলুন, বিউটি পারলার ও ব্যাংকের এটিএম বুথ। দোতলায় একাধিক সমবায় সমিতির কার্যালয়, পাশে স্কুলটির অফিস কক্ষ ও একটি শ্রেণিকক্ষ। তিনতলার এক পাশে আবাসিক ফ্ল্যাট, আরেক পাশে স্কুলের জন্য নেওয়া একটি কক্ষ।
গত মঙ্গলবার দুপুরে স্কুলে গিয়ে কাউকে পাওয়া গেল না, অফিস বন্ধ। তবে স্থানীয় এক ছাত্র ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমারুল হোসেনের ফেসবুক পোস্ট দেখিয়ে বলেন, ২০১৭ সালে ওই বিদ্যালয় থেকে ২২ জনের মতো এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সবাই পাস করেছে। এ প্লাস পেয়েছে অর্ধেকের বেশি।
ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তানভীর হোসেনের এক ফুফাতো ভাই প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া সজীব মিয়া তানভীরের বোনের স্বামী। তিনি বলেন, ‘র্যা বে যেহেতু তাঁরে ধরছে নিশ্চই কিছু পাইছে। আমরা হাছামিছা কিছু জানি না।’
তবে তানভীরের বাবা আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। তাঁর ছেলে তানভীর ও জামাই সজীব অনেক কষ্ট করছেন বিদ্যালয়টি দাঁড় করাতে। সজীবের সঙ্গে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক এনামুলের বন্ধুত্ব ছিল। এনামুলই তাঁদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
তাঁদের বাড়িতে কথা হয় গ্রেপ্তার সজীব মিয়ার স্ত্রী আফরোজা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর এন্ড্রয়েড মুঠোফোনটি দুই দিন আগে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়েছে। সেটিও র্যা ব নিয়ে গেছে।

বাড়তি টাকা দেন অভিভাবকেরা
তানভীর ও সজীবের স্বজনেরা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও এলাকাবাসীর কাছে বোর্ডের পরীক্ষায় বাড়তি সুবিধা আদায় করে দেওয়ার বিষয়ে ‘সুনাম’ রয়েছে।
একজন পোলট্রি ব্যবসায়ী বলেন, গত বছর তাঁর ছেলে ক্যামব্রিজ স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে এ প্লাস পেয়েছিল। পরীক্ষার আগে অতিরিক্ত সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে ওই অভিভাবক বলেন, ‘তা বলতে পারব না। তবে তারা (শিক্ষকেরা) খাটছে, পরীক্ষার সকালে সিউর সাজেশন দিছে।’
ওই অভিভাবকের মুঠোফোনে কথা হয় ক্যামব্রিজ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী এক অভিভাবকের সঙ্গে। ব্যবসায়ী ওই ব্যক্তি বলেন, স্কুলের শিক্ষকেরা ভালো ফলের জন্য পরিশ্রম করেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেতে অতিরিক্ত টাকা দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোচিংয়ের জন্য ট্যাকা দিছি।’ তিনি পরীক্ষার দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের আলাদা করে পড়ানোর কথা জানান। তবে কী পড়ানো হয় সে বিষয়ে তাঁর ধারণা নেই।
র্যা বের ভাষ্যমতে, ওই স্কুলের শিক্ষকেরা পরীক্ষা শুরুর দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হাতে পেয়ে সেটির বহুনির্বাচনী অংশের চটজলদি সমাধান করতেন। কখনো কখনো সমাধানসহ ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কেনা হতো। এরপর সেই উত্তরগুলো শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে তাঁরা পরীক্ষার হলে ঢোকাতেন।
গ্রেপ্তার হওয়া তানভীর পরীক্ষার আগে সকাল কটার সময় বাসা থেকে বের হতেন জানতে চাইলে তাঁর মা তাসলিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল সকাল বাসা থিকা বাইরাইলেই কি সে এসব করছে নাকি।’ তানভীরের বাবা আলী হোসেন বলেন, বেসরকারি স্কুলে বেতনের বাইরে টাকা নেওয়া হয় না। যে অভিভাবক টাকা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন, তিনি মিথ্যে বলেছেন।
বালু নদের পাড়ে চায়ের দোকানে বসে কথা হয় এক অভিভাবকের সঙ্গে, যাঁর ছেলে অন্য বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার পোলায় কয় ওই (ক্যামব্রিজ) স্কুলের মাস্টাররা প্রশ্ন দেয়। আমার পোলাও প্রতিদিন পরীক্ষার আগে খালি মোবাইল গুঁতায়। আমি বকাবকি করছি। এহন সবাইরেই দেহি একই কাম করে। আর কিছু কইতে পারি না।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি
স্থানীয় লোকজন জানান, চার বছর ধরে স্কুলটির শিক্ষকেরা পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় এ প্লাসের নিশ্চয়তা দিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করছেন। ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের ফলও ভালো। শুধু ক্যামব্রিজ বিদ্যালয় নয়, এ ইউনিয়নে এমপিওভুক্ত এবং নন-এমপিও সব মিলিয়ে ১৫টির মতো বিদ্যালয় রয়েছে।
কাঁচকুড়া হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রণজিৎ কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরখান ইউনিয়নে ছয়টি এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো হলো বেলায়েত হোসেন উচ্চবিদ্যালয়, বিবিএম হাইস্কুল, ময়নারটেক হাইস্কুল, উত্তরখান ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়, কাঁচকুড়া হাইস্কুল ও কলেজিয়েট উচ্চবিদ্যালয়। এখানে অনেক বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় দুজন দোকানদার, একজন পোশাক কারখানার চাকুরে, একজন অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, কাঁচকুড়ায় শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। শিক্ষকেরা বাড়িতে এসে শিক্ষার্থী খুঁজে যান। বোর্ডের পরীক্ষায় কেউ এ প্লাসের নিশ্চয়তা দেন। মাসে ন্যূনতম বেতন হাজার টাকা।
তবে কাঁচকুড়ার বেসরকারি বিদ্যালয় সানফ্লাওয়ার হাইস্কুলের অধ্যক্ষ এ কে এম হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, অভিভাবকেরা যে এ প্লাসের নিশ্চয়তা দিয়ে ভর্তি করানোর কথা বলছেন, তা ঠিক নয়। তিনি কখনোই ‘গ্যারান্টি দিয়ে’ শিক্ষার্থী ভর্তি করান না। এলাকায় এমন বেশ কয়েকটি বেসরকারি (এমপিওভুক্ত নয়) স্কুল রয়েছে। যেগুলোর শিক্ষার্থীরা স্থানীয় বিবিএম হাইস্কুল থেকে নিবন্ধন করে বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এবার তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ১৩ জন শিক্ষার্থী এসএসসিতে অংশ নিচ্ছে বলে তিনি জানান।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দোষ না খুঁজে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গোড়ায় নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন উত্তরখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি থাকলে শিক্ষার প্রসার ঘটবে এ রকমটিই সবাই ভাবে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে নিরুৎসাহিত করা হয় না। তিনি বলেন, প্রশ্নের বিষয়টা এ রকম হয়ে গেছে যে একজন পাচ্ছেন, অন্যকেও দিচ্ছেন। মূল জায়গার লোকগুলোকে ধরতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, প্রশ্ন ফাঁসে অভিভাবকদের তহবিলের বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে ওরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি উত্তরখান থানায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে জেনেছেন তাঁরা সকালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্ন পেতেন বলে জেনেছেন।