চীন-ভারতের 'লড়াই'য়ে বাংলাদেশ জড়িত না

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কিছু নেই —প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য সঠিক বলেই মনে করছেন কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। ভারতীয় সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপের কোনো ঝুঁকি দেখছেন না তাঁরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের চলমান সম্পর্ক অর্থনৈতিক ছাড়া আর কিছুই নয়। তা ছাড়া চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ‘লড়াই’ মনোভাবে বাংলাদেশ কোনোভাবেই জড়িত না।

গত মঙ্গলবার সরকারি বাসভবনে ভারতীয় সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি তাঁদের বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজের এ বক্তব্যের ব্যাখ্যাও ওই সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা শুধু দেশের উন্নয়নের জন্য। তিনি বক্তব্যকে আরও খোলাসা করে বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে—এমন যেকোনো দেশের সঙ্গে তাঁর সরকার সহযোগিতার হাত বাড়াতে প্রস্তুত।

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের মতামত নেওয়া হয়। তাঁদের সবার বক্তব্যেই ওঠে আসে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রসঙ্গ। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর সব দেশের মধ্যেই পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। একটি দেশ চলতে হলে তাকে সবার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে হয়। তাঁরা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

হুমায়ুন কবির
হুমায়ুন কবির

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীরের মতে, প্রধানমন্ত্রী সঠিক কথাটাই বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথম হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা কী, সেটা দেখতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দরকার। তা ছাড়া এ অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকুক, তা-ও আমরা চাই। এ ধরনের সম্পর্ক দ্বন্দ্ব নয়, একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করবে এবং ওই দুই দেশের সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বিষয়টি ভারত বা চীনের দৃষ্টিতে না দেখে আমাদের চাহিদা বা প্রত্যাশার কথা ভাবতে হবে। সবার স্বার্থেই সম্পর্কোন্নয়নে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

ইমতিয়াজ আহমেদ
ইমতিয়াজ আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা মূলত অর্থনৈতিক। চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার। ভারত প্রতিবেশী এবং বড় দেশ। জাতীয় স্বার্থে দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। একজনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ বা ভালো হবে, এমনটা নয়। প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে যেটা বলেছেন, তা খুবই সঠিক কথা। ভারত ও চীনের মধ্যকার যে লড়াই, সেখানে বাংলাদেশ জড়িত না। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তাতে কোনোভাবেই বলা যাবে না বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।

সাখাওয়াত হোসেন
সাখাওয়াত হোসেন

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘চীন অবকাঠামোর দিকে বিনিয়োগ করছে। টেকনিক্যাল সহায়তা দিচ্ছে। পদ্মা সেতুতেও রয়েছে—এগুলো উন্নয়নেরই বিষয়। ভারতের সঙ্গেও তো আমাদের উন্নয়নের সম্পর্ক আছে। রেলের উন্নয়নেও তো ভারত অর্থ দিয়েছে। ভারতের একটা উদ্বেগ তো আছেই। ভারতের প্রতিযোগিতা চীনের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে চীনের ভূরাজনৈতিক বিষয় আছে বলে আমার মনে হয় না। ভারতের উদ্বেগটা সেখানেই হতে পারে। সেটাকে আশ্বস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে উন্নয়নের সম্পর্ক, সে সম্পর্ক তো দুনিয়ার সবার সঙ্গেই আছে। উপমহাদেশে চীনের উপস্থিতিটা একটা শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটা আগের চেয়ে অগ্রগতি হয়েছে। সীমান্ত ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে চীনের একটি বৈরী সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা প্রচুর। আমাদের সঙ্গে তো চীনের কোনো সীমান্ত সম্পর্ক নেই। ওটাই হয়তো প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন।’

আমেনা মহসিন
আমেনা মহসিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, এ অঞ্চলে চীনকে নিয়ে একটা উদ্যোগ আছে। তবে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি এক দেশকেন্দ্রিক হয় না। অনেক দেশকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়। প্রধানমন্ত্রী কথাটি বলে ভারতকে ‘আস্থা’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ভারতের সহায়তার কথা বলেছেন।