পুরোনো মামলায় নতুন আসামি

>খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাড়ে তিন হাজার লোক গ্রেপ্তার হন। তাঁদের অধিকাংশকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাড়ে তিন হাজারের বেশি লোককে জেলে ঢুকিয়েছে পুলিশ। এঁদের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তিকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এসব মামলার এজাহারে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বড় অংশের নাম ছিল না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের রায়কে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হলেও এ সময় অনেকে পুলিশি হয়রানি ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন; এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে গত ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্ট এলাকায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা পুলিশের প্রিজন ভ্যানে হামলা চালান। এরপর ওই দিন থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে ধরপাকড় শুরু হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১৬ দিন এই ধরপাকড় চলে।

প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে এই ১৪ দিনে ঢাকায় ১ হাজার ২০০ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৬৮২ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে।

আদালত থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে কেবল ঢাকা থেকেই ৯৪০ জনকে ১০৫টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২০টি, বিস্ফোরক আইনে ৩০টি মামলা রয়েছে। অন্যগুলো সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগের মামলা। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্তত আড়াই শ ব্যক্তিকে পুলিশ রিমান্ডে নেয়।

৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ ও কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেপ্তার হওয়া অন্তত ৫০ জনের স্বজন ও আইনজীবীর সঙ্গে কথা
হয় প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, কাউকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে, কাউকে রাস্তা থেকে আবার কাউকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন থানার পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নতুন মামলায় যাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তাঁদের বড় অংশের বিরুদ্ধেও পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেখাতে পারেনি।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলেছেন, তাঁদের হয়রানির কোনো শেষ নেই। পুরান ঢাকার হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মচারী আবদুল গফুরের মা সত্তরোর্ধ্ব রাবেদা বেগম জানালেন, তাঁর ছেলেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ছেলের খোঁজে প্রথমে তিনি থানায় যান। জানতে পারেন আদালতে পাঠানো হয়েছে। এরপর আদালতের হাজতখানায় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে লম্বা সময় ছেলের দেখা পেতে। পরে জানতে পেরেছেন তাঁর ছেলেকে গত বছরের নভেম্বরে কোতোয়ালি থানায় বিস্ফোরক আইনের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

কামরাঙ্গীর চরের ব্যবসায়ী হাজি আবদুল মজিদকে (৬৩) ২ ফেব্রুয়ারি সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর গত বছরের ১৯ জুন পুলিশের ওপর হামলা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর আইনজীবী মাসুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মজিদ রাজনীতি করেন না। অসুস্থ থাকার পরও তিনি জামিন পাচ্ছেন না।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশ কমিশনার এ দাবি করলেও বাছবিচার না করে গ্রেপ্তারের আরও উদাহরণ আছে। এমনকি আওয়ামী লীগের কর্মীকেও বিএনপি মনে করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক এমন এক ব্যক্তির নাম মুশতাক আহমেদ। তাঁর আইনজীবী মাহবুবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, মুশতাক ডাক্তার দেখাতে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। রমনা থানায় গত ৩০ জানুয়ারির বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, সেটির এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ১৪২, তাতে মুশতাকের নাম নেই। মুশতাক যে আওয়ামী লীগের কর্মী, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতারা প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন, তা আদালতে জামিন আবেদনের সঙ্গে জমা দিয়েছেন আইনজীবী।

আইনজীবীরা বলছেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক আইনের মামলা অজামিনযোগ্য, অন্য যেসব অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেগুলোতেও জামিন পাওয়া কঠিন। ফলে হয়রানির মাত্রা বেড়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হয়রানিমূলক গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা হতে পারে।

ঢাকার বাইরে

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার ওয়াপদা বাজারের রড-সিমেন্টের ব্যবসায়ী বাচ্চু মোল্লা। নাকোল ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকও তিনি। ৫ ফেব্রুয়ারি দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন।

বাচ্চু মোল্লার স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের আগে পুলিশ বাচ্চু মোল্লার কাছ থেকে টাকাপয়সা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। ১৫১ ধারার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর পাঁচ দিনের মাথায় তিনি জামিনও পান। পরে পুলিশ পাশের আমলসার ইউনিয়নের নবগ্রামের একটি হত্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার (শ্যোন অ্যারেস্ট) দেখায়।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাজমা খাতুনও গ্রেপ্তার হয়েছেন বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায়। তাঁর স্বামী রফিক মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ি থেকে তাঁর স্ত্রীকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর রাতে তিনি শুনতে পান তাঁর বাড়িতে বোমা পাওয়া গেছে। তিনি হতবাক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রেপ্তার হওয়া বড় অংশকে ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ জানুয়ারি মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে সহিংসতা হয়, সেই ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাঁদের একজন শফিকুর রহমান। শফিকুরের স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেন, আট বছর মালয়েশিয়ায় থাকার পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শফিকুর দেশে আসেন। কিন্তু তাঁকে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে সহিংসতার ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবীর হোসেন গতানুগতিক জবাব দিয়েছেন, যাঁরা জড়িত তাঁদেরই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) সহেলী ফেরদৌস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন অপারেশনাল ইউনিট প্রধানদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মামলা ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

তবে খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে এই পর্যন্ত বিএনপির কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশের কাছ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে সে হিসাব পাওয়া যায়নি। ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপি অভিযোগ করেছে, ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির ৪ হাজার ৭২৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁরা মূলত ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন এই সময়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দিতে শুরু করেছে পুলিশ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। তবে শুধু ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িত রয়েছে বা সুনির্দিষ্ট অপরাধে দোষী এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। যাচাই-বাছাই না করে গ্রেপ্তার কোনোভাবেই কাম্য নয়।

 (প্রথম আলোর পাবনা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জয়পুরহাট, যশোর, জামালপুর ও কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে)