রূপান্তরিত তেজগাঁওয়ে শহর অচলের শঙ্কা

>

• যত খুশি উঁচু ভবন তৈরির সুযোগ।
• পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা।
• আগে পরিবহন, জনঘনত্ব ও পরিবেশগত পর্যালোচনা চায় বিআইপি।

গুগল আর্থে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল
গুগল আর্থে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল

তেজগাঁও এলাকায় যত খুশি তত উচ্চতার বাণিজ্যিক ভবন করা যাবে। গত মঙ্গলবার চূড়ান্ত হওয়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের রূপান্তরিত প্লট-সংক্রান্ত খসড়া বিধিমালায় এই অবারিত সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে শহরের পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা করা হয়নি। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, পুরো শহরের বিবেচনায় তেজগাঁওয়ের অবস্থান ও এর বিশালত্ব বিবেচনায় নিলে এই বিধিমালা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ভবিষ্যতে পুরো শহরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।

তবে খসড়া অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ীই সব করা হয়েছে। তবে তাঁরা এ-ও বলেছেন, যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আলোকে এই বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, তা-ই শিগগির সংশোধন করা হবে। ফলে তেজগাঁওয়ের জন্য করা বিধিমালা তখন ইমারত নির্মাণের মূল বিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে কি না, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে।

গত মঙ্গলবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিধিমালা প্রণয়নসংক্রান্ত কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে খসড়া বিধিমালাটি অনুমোদন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান। এখন খসড়া বিধিমালাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ৫০০ একরের বেশি জায়গা নিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল গঠিত হয়। এখানে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৩০টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২০ জুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই এলাকার ভূমি শিল্প কাম বাণিজ্যিক ও আবাসিক প্লট হিসেবে রূপান্তর করা হয়। রূপান্তরিত প্লটের জন্য একটি মহাপরিকল্পনাও করা হয়। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী রূপান্তরিত ভূমিতে ভবনের আকৃতিসহ আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি কেমন হবে, তা নির্ধারণে বিধিমালা প্রণয়নের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতিসহ আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বিধিমালার একটি খসড়া করে তার ওপর মতামত দিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সকে (বিআইপি) অনুরোধ করে।

বিআইপি ওই খসড়া বিধিমালার বিষয়ে তাদের আপত্তি জানায়। তারা বলেছে, রূপান্তরের কারণে পরিবহন ব্যবস্থাপনার ওপর এর প্রভাব (ট্রাফিক ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট), জনঘনত্ব জরিপ এবং নগর ব্যবস্থাপনায় এর সামগ্রিক প্রভাব পর্যালোচনা করতে হবে। সে প্রতিবেদন পেলে তারা তাদের মতামত কমিটিকে জানাবে।

১৪ ফেব্রুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এ বিষয়ে চিঠি দেয় বিআইপি। চিঠিতে বলা হয়েছে, তেজগাঁও শিল্প এলাকা ঢাকা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত বিধায় এ এলাকার ভূমি ব্যবহারসংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা ঢাকা শহরের নগর ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক, পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া হাতিরঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তেজগাঁও এলাকার কাছে অবস্থিত হওয়ায় এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত বিশদ পর্যালোচনার ভিত্তিতে নেওয়া উচিত।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পর্যালোচনাগুলো আমরা নিজ অর্থায়নে করে দিতে চেয়েছিলাম। আমাদের আপত্তির কথা গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিটির সর্বশেষ সভাতেও জানানো হয়েছে। কিন্তু কমিটি আমাদের আপত্তি আমলে নেয়নি। পরিবহন ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পর্যালোচনা ছাড়াই কমিটির পক্ষ থেকে খসড়া বিধিমালাটি অনুমোদন করা হয়েছে।’

কমিটির প্রধান রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান নির্মাণ বিধিমালা নিয়েই সবকিছু করা হয়েছে ও খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। আর পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিআইপি যা বলছে, সেটাও মানা হয়েছে।

সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হলে পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এর কী প্রভাব পড়বে, তা দেখার দায়িত্ব ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। জানতে চাইলে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এই বিধি প্রণয়ন সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। রাজধানীতে ১০ তলার ওপর ভবন নির্মাণ করতে হলে ডিটিসিএর অনুমোদন নিতে হয়।

খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, রূপান্তরিত প্লটে যেসব ভবন নির্মাণ করা হবে সেসব ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভবনের বাইরের খোলা জায়গায় বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। ৫০০ বা এর অধিক আবাসন ইউনিট বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেসিন এবং গোসলের পানি পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভবনে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, প্লটের সঙ্গে ৬০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকলে যেকোনো উচ্চতার বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা যায়। শহরের অন্যান্য অংশে এমন প্রশস্ত রাস্তা কম থাকায় কোনো এলাকায় বেশি সংখ্যায় সুউচ্চ ভবন করার সুযোগও কম থাকে। ফলে ওই পুরো এলাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ও পরিবেশের ওপর এসব ভবনের প্রভাব তেমন প্রকট হয় না। কিন্তু ৫০০ একর আয়তনের তেজগাঁও এলাকার বেশির ভাগ রাস্তা ৮০ ফুট প্রশস্ত। ফলে নতুন বিধি অনুযায়ী পুরো তেজগাঁওয়েই বিপুলসংখ্যক সুউচ্চ ভবন তৈরির সুযোগ থাকবে। এতে এখানকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা এবং এর আশপাশের এলাকাসহ পুরো শহরে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিআইপিসহ নগর গবেষকেরা।

বিআইপির সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী ওই এলাকায় ২৫-৩০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। আমাদের আশঙ্কা, এমন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করলে ভবিষ্যতে ওই এলাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। যার প্রভাব গুলশান, হাতিরঝিল, বাংলামোটর পর্যন্তও পড়বে। রাজধানীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ট্রাফিক ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টসহ অন্যান্য পর্যালোচনা না করে এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত হবে না।’

জানতে চাইলে নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিআইপি যে কথা বলেছে এটাই সমর্থনযোগ্য। শহরের মাঝখানে এত বড় একটা পরিবর্তন হবে, দীর্ঘ মেয়াদে পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর এর প্রভাব কী হবে, তার জন্য বিস্তারিত পর্যালোচনা দরকার। পর্যালোচনা ছাড়া এত তাড়াহুড়ো করে কেন বিধি করা হচ্ছে, সেটাই প্রশ্ন।