মতপ্রকাশে বাধা, গুম ও ধরপাকড় চলছে

>

• মানবাধিকারবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের।
• প্রতিবেদনে ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারের চিত্র।
• রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ।

বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকারের ওপর বাধা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। চলছে গুম, বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়, মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। বিপরীতে ইতিবাচক ঘটনা, এক দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশের চরম দারিদ্র্য কমাতে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এই পর্যবেক্ষণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি গত বুধবার তাদের মানবাধিকারবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এতে।

মতপ্রকাশে বাধা
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা বন্ধ হয়নি। গত বছর কয়েকজন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। নিহত হন সমকাল-এর শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারে অন্যায়ভাবে বাধা সৃষ্টি এবং সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের নিশানা বানানো ও হয়রানি করার লক্ষ্যে সরকার দমনমূলক আইনের প্রয়োগ করে যাচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) নিপীড়নমূলক ধারা বাতিলে মানবাধিকারকর্মীরা বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও শাস্তিমূলক বিধানগুলো অক্ষত রাখা হয়েছে। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালুর যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তা অনলাইনে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারে আরও বাধা সৃষ্টি করবে।
শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার ভীষণভাবে সীমিত। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বৈঠক-সমাবেশ আয়োজনের অধিকারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম) নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় সীমিত রাখা হচ্ছে বেসরকারি সংগঠনগুলোর (এনজিও) তৎপরতাও।

গুম হচ্ছে নিয়মিতভাবে
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা ঘটছে নিয়মিতভাবে। এর প্রধান শিকার হচ্ছেন বিরোধীদলীয় সমর্থকেরা। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কারও কারও লাশ মিলেছে। চলতি ফেব্রুয়ারিতে গুমবিষয়ক জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুমের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত বছর ৮০ জনের বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। গত অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুবাশ্বার হাসানের কথিত অপহরণ ও ৪৪ দিন পর তাঁর বাড়িতে ফিরে আসার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও অন্যান্য ধরনের অসদাচরণের ঘটনা এখনো ব্যাপক। কিন্তু এসব ঘটনায় তদন্ত বিরল। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সচেতনতার অভাবে ‘দ্য ২০১৩ টর্চার অ্যান্ড অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট ২০১৭-১৮ ৮৯ কাস্টডিয়াল ডেথ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট’-এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে নিয়মিত গুমের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা সত্য নয় বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, প্রতিবেদনে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের কাউকেই সরকার আটক করেনি। তাই কাউকে ছেড়ে দেওয়া বা আটক রাখার প্রশ্নই ওঠে না। বরং বিভিন্ন সময় বিরোধীদলীয় নেতা-সমর্থকেরা গুম হয়েছেন বলে বলা হয়, পরে আবার তাঁদের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে ভাঙচুর করতে দেখা যায়। মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সারা বছরই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা তথ্যভিত্তিক নয়। এবার আমরা আনুষ্ঠানিক জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ
অভিযোগ করা হয়, বিচার বিভাগের ওপর ক্রমবর্ধমান সরকারি হস্তক্ষেপে উদ্বেগ বাড়ছে। উদাহরণ হিসেবে গত বছরের জুলাইয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ওই রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। এর ধারাবাহিকতায় নভেম্বরে এস কে সিনহা দেশ ছাড়েন এবং পরে পদত্যাগ করেন।
আইনজীবী শাহদীন মালিক সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এটা সার্বিকভাবে অনস্বীকার্য যে গত বছর মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গুম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধমূলক আচরণ ও বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার প্রকৃত চিত্রই উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। সরকার যতই অস্বীকার করুক, এ প্রতিবেদনে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার সঙ্গে ভুক্তভোগী ও দেশের সাধারণ মানুষেরা একমত হবে। আর মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত আগস্টে সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের নিষ্ঠুর হামলা-নির্যাতন শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তবে বলা হয়েছে, এসব রোহিঙ্গাকে আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থীর মর্যাদা দিতে বাংলাদেশ অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছে বলেও উল্লেখ করেছে অ্যামনেস্টি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম
গত জুনে রাঙামাটির লংগদুতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় অন্তত একজন নিহত এবং দুই শতাধিক বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ ও তাদের বাড়িঘরের ওপর হামলার ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে। সংস্থাটির অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজনের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।