এখানে তো বেশ আছি
>
- মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনে গত ছয় মাসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
- এখানে ভালোই আছেন বলে জানালেন কয়েকজন রোহিঙ্গা
বালুখালী বিএমএস-১ মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে চায়ের দোকানে ঢুকলেন রবিউল হাসান। রবিউল জানালেন, ফজরের নামাজও তিনি এই মসজিদেই পড়েন। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। বাকি সময় শিবিরের ঘরে শুয়ে-বসে কাটান। মাঝে দু-একবার চায়ের দোকানে আড্ডা দেন। এভাবেই চলছে গত প্রায় ছয় মাস। রবিউলের ধারণা, এ রকম চলবে হয়তো বাকি জীবন।
রবিউলের বয়স ৩৫ বছর। তিনি আছেন বালুখালী-১ শিবিরে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনে গত ছয় মাসে যে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছে, রবিউল তাদের একজন।
বালুখালী-১ শিবিরের কাছে রবিউলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা স্থানীয় আমির হোসেনের চায়ের দোকানে ভিড় জমায়। এদের কারও বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু এলাকায়, কারও বাড়ি বুচিডং এলাকায়, কারও সিটুওয়ে বা রাচিডংয়ে।
কথা ওঠে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগ নিয়ে। রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমার-বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি সই হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা থামেনি। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাবাসনের জন্য ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা হস্তান্তরের পর থেকে গত সাত দিনে টেকনাফে এসেছে ৬১৮ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ গতকাল এসেছে ৭২ পরিবারের ২৫৩ রোহিঙ্গা। আর চুক্তি হওয়ার দিন থেকে গত তিন মাসে টেকনাফে এসেছে ১০ হাজার ৯৩৫ রোহিঙ্গা।
এসব আলোচনার মধ্যে আবু জামিল বলে বসলেন, ‘কেন যাব? এখানে তো বেশ আছি।’ নিজ দেশে আবু জামিলের চায়ের দোকান ছিল। সেই অভিজ্ঞতার জোরে বাংলাদেশের আমির হোসেনের দোকানে কাজ পেয়েছেন জামিল।
তবে ‘বেশ আছি’ কথাটি শুধু জামিলের একার নয়। গতকাল শুক্রবার কুতুপালং ও বালুখালী শিবিরে যত রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশে ভালো আছেন। তবে আবু জামিল এ-ও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার পাঠালে আমাদের যেতেই হবে। আমরাও মানুষ, আমাদের আবার যেন অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণের মুখে পড়তে না হয়, সেটিও যেন বাংলাদেশ সরকার ভেবে দেখে।’
কুতুপালংয়ের লাম্বাসিয়া শিবিরে একটি ঘরে পাঁচ সদস্য নিয়ে থাকেন মোহাম্মদ সাবের। বয়স ৫০ বছরের বেশি। সকালে ভাত খেয়েছিলেন বলে জানালেন। দুপুরে ও রাতে ভাতের ব্যবস্থা। তিন বেলা এভাবেই চলছে। সাবের বললেন, এখানে খাবারের কোনো কষ্ট নেই। চলাফেরায় কিছু বিধিনিষেধ আছে। যেমন চাইলেই রোহিঙ্গারা যেখানে-সেখানে ঘুরতে যেতে পারে না। সেই সমস্যা মিয়ানমারেও ছিল। এখানে আছে নিরাপত্তা, যা মিয়ানমারে কোনো দিন ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না।
শিবিরবাসী, সরকারি কর্মকর্তা ও এনজিও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রাণসামগ্রীর কোনো অভাব নেই রোহিঙ্গাদের। এমনকি বাড়তি চাল, ডাল, চিনি, তেল, কম্বল, থালাবাটি রোহিঙ্গারা নিয়মিতভাবে স্থানীয় মানুষের কাছে বিক্রি করছে। সাধারণত বিকেলে এসব সামগ্রী নিয়ে তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কর্মকর্তারা কাজ শেষে শহরে ফেরার সময় অল্প দামে কিনে নেন।
একটি বেসরকারি সংস্থার পুষ্টি কেন্দ্রে কথা হয় হাজেরা বেগমের সঙ্গে। বয়স ২৮ বছর। তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মা। তিনি জন্মের পর থেকেই মিয়ানমার সেনাদের নানা ধরনের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে জীবন পার করেছেন। এ দেশে আসার আগে একটি স্কুলে তাঁর স্বামী ও তাঁকে বেঁধে নির্যাতন করেছিল মিয়ানমারের সেনারা। এ দেশে হাজেরা বেগমও বেশ নিরাপদে আছেন।
গত বছরের ২৪ আগস্ট রাখাইনের মংডু এলাকায় কিছু নিরাপত্তাচৌকিতে আরসার সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই অজুহাতে পরদিন থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় সশস্ত্র বৌদ্ধদের একটি অংশ। রোহিঙ্গারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ প্রায় সব ধরনের নির্যাতনের মুখে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি বাংলাদেশে আসে গত বছরের ২৫ আগস্ট, ছয় মাস আগে।
ছয় মাস তো খুবই কম সময়। ২০০৫ সালের পর বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার আর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়নি। তাই এবারের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগও সফল হবে না বলে রোহিঙ্গারা মনে করে। তারা বলছে, ফেরত পাঠানোর প্রথম শর্ত নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কোনো দিন রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেবে না।
তাই অনেকেই ভবিষ্যৎ দেখছেন বাংলাদেশে। রাখাইনে মোহাম্মদ সাবেরের বাড়ির পাশের স্কুলটি সেনাবাহিনী ছয় বছর আগে বন্ধ করে দিয়েছিল। কুতুপালংয়ে ১০ বছরের মেয়েকে একটি এনজিওর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন।
১৯৭৮ সালে ‘ড্রাগন অপারেশনের’ সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা প্রথম বাংলাদেশে এসেছিল। তাদের একটি অংশ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। তারপরও কয়েক দফায় রোহিঙ্গারা এসেছিল। সবাই ফেরত যায়নি। বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার অতীত অভিজ্ঞতাকে নতুন আসা রোহিঙ্গারা কাজে লাগাতে চাইছে।