'কেউ পিছিয়ে পড়লে হবে না'

গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, সাংসদ আশেক উল্লাহ ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের উপপ্রধান মনিরুল ইসলাম। প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, সাংসদ আশেক উল্লাহ ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের উপপ্রধান মনিরুল ইসলাম। প্রথম আলো

নারী-পুরুষের সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনো খুব একটা ভালো নয়। তবে গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল। এখন এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) অর্জনের কাজ চলছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কেউ পিছিয়ে পড়লে এই লক্ষ্য অর্জন হবে না।

গতকাল শনিবার কক্সবাজারের সি-গাল হোটেলে প্রথম আলো আয়োজিত ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যের সুরক্ষা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। এই আয়োজনে সহযোগিতা করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএনএফপিএর কর্মকর্তা আবু সাইদ হাসান। তিনি বলেন, এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে যদি কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষ পিছিয়ে পড়ে, সেই মানুষগুলোকে খুঁজে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। কেউ পিছিয়ে পড়লে টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হবে। কোনো জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ছে কি না, তা চিহ্নিত করতে হবে। তারা যাতে সুচিকিৎসা ও মানসম্মত শিক্ষা পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রে আশানুরূপ সুফল হয়নি দাবি করে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মো. আবদুস সালাম বলেন, কিছু এলাকা বেশি দুর্গম হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা সমভাবে বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছে না। রোহিঙ্গা শিবিরে ৩০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারী রয়েছেন। তাঁদের নিরাপদ প্রসব স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনবল এবং তহবিলসংকটের কারণে তৃণমূল পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ কক্সবাজারের উপপরিচালক পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বেসরকারি সংস্থাগুলো স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হলেও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে আগ্রহ দেখায় না।

২৫০ শয্যার সরকারি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়মিত ৬০০ থেকে ৭০০ জন রোগী ভর্তি থাকে বলে জানান হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক পু চ নু। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাঢলের পর রোগীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। কিন্তু সেই পরিমাণে চিকিৎসক নেই।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্টট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, গত চার মাসে প্রশাসনের নানা জটিলতার কারণে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য আসা ১৪ মিলিয়ন ডলার ফেরত গেছে। এটি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ২০১৯ সালের পর থেকে এত বেশি বিদেশি অর্থসহায়তা আসবে না। যে পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের জন্য বছরে প্রয়োজন হবে ৯ হাজার কোটি টাকা।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম রহিমুল্লাহ বলেন, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও সন্তান প্রসবের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালেও অনেক সময় চিকিৎসকের দেখা মেলে না। কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মায়েঁনু বলেন, রাখাইন সমাজ অত্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত। তাদের মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। রাখাইন নারীরা ভাষাগত সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে চান না। বেসরকারি সংস্থা ইপসার কর্মকর্তা খালেদা বেগম বলেন, নানা সমস্যা অতিক্রম করে চাকরিতে ঢুকলেও কর্মস্থলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন নারীরা। এমডিজি ও এসডিজি সম্পর্কে বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তেমন কিছু জানে না।

ইউএনএফপিএর জেন্ডার ইউনিটের প্রধান শামীমা পারভিন বলেন, নারীদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে ওই নারী ভাবতে শেখেন একজন স্ত্রী ও মায়ের বাইরেও তিনি একজন মানুষ। এই সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুরুষকে ভূমিকা নিতে হবে।

মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘নোঙর’-এর নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম বলেন, অনেক পুরুষ মনে করেন, নারীরা বাইরে চাকরি করলে সন্তানদের সময় দিতে পারবেন না। নারীদের প্রধান দায়িত্ব সন্তানদের সামলানো। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা এই ধারণা বেশি পোষণ করেন। কক্সবাজার বিতর্ক ক্লাবের সভাপতি শামীম আকতার বলেন, বাল্যবিবাহের জন্য শুধু দরিদ্রতাই একমাত্র কারণ নয়। এর পেছনে রয়েছে শিক্ষার অভাব, অসচেতনতা, কুসংস্কার ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা।

কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান বলেন, সাগর উপকূলে জেলে-পরিবারের নারীরা শুঁটকি উৎপাদন ও পোনা সংগ্রহ করে আয় করেন। শুঁটকি উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় একজন নারী শ্রমিককে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। কিন্তু তাঁরা পুরুষদের চেয়ে কম মজুরি পান।