'বড় ভাই'দের কাছে অস্ত্র পায় তারা

চট্টগ্রাম শহরে কিশোরদের মধ্যে ছোটখাটো বিরোধেও এখন অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এ অস্ত্র তারা পাচ্ছে ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার কাছ থেকে। ‘বীরত্ব’ দেখানো শেষ হলে তারা সেই অস্ত্র (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিস্তল) বড় ভাইদের ফিরিয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম শহরে স্কুলপড়ুয়া এক কিশোর খুন হওয়া এবং পুলিশকে গুলি করার মতো আলোচিত দুটি ঘটনার তদন্তে ভয়ংকর এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

নগরের বিভিন্ন স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির বেশ কিছু শিক্ষার্থী রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও শিক্ষকেরা। তুচ্ছ ঘটনায় কিশোরেরা নিজেদের মধ্যে অস্ত্র নিয়ে একের পর এক হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ভাবাচ্ছে পুলিশকেও। সাম্প্রতিক সময়ে খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার কয়েকজন কিশোর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বড় ভাইদের কাছ থেকে অস্ত্র নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু বলেন, বাড়িতে ও স্কুলে খেলার জায়গা না থাকায় কিশোরেরা বাইরে সময় পার করছে। এ সুযোগে সন্ত্রাসী, মাস্তানেরা তাদের দলে টানছে। এ বয়সে কিশোরেরা বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কার সঙ্গে সন্তান মিশে, অভিভাবকদের খোঁজ রাখতে হবে।

সর্বশেষ ১৬ ফেব্রুয়ারি এক বন্ধুকে শায়েস্তা করতে গিয়ে রাস্তায় হঠাৎ তল্লাশির মুখে পড়ে পুলিশকে গুলি করার মতো কাণ্ড ঘটিয়েছে কিশোরদের একটি দল। চট্টগ্রামের ষোলশহরের ২ নম্বর গেট এলাকার ব্যস্ত সড়কে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের মুখোমুখি হওয়ার পর আতঙ্কে মোটরসাইকেল ফেলে চলে যাওয়ায় ধরা পড়ে তারা। তাদের দুজন শহরের দুটি নামী স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানও তারা।

এর আগে ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জামালখান এলাকার ফুটপাতে দিনদুপুরে কয়েকজন কিশোর প্রকাশ্যে খুন করে তাদেরই পরিচিত এক সহপাঠীকে। দুটি ঘটনায় তাদের অস্ত্র দেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই নেতা।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক বড় ভাইদের সান্নিধ্যে থাকায় স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের একটি অংশের মধ্যে বেপরোয়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে। ছোটখাটো বিরোধেও অস্ত্র দেখিয়ে বীরত্ব জাহির করতে চায়।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া কিশোরেরা বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নগরের গোল পাহাড় মোড়, জিইসি মোড়, ষোলোশহর ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, জামাল খান, গণি বেকারি, চকবাজার, সিআরবি মোড়, আগ্রাবাদসহ আরও কয়েকটি স্থানে আড্ডা দেয়। গত এক মাসে এসব আড্ডাস্থল থেকে ৬০ কিশোরকে ধরে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দিয়েছে পুলিশ। এলাকায় আড্ডা দিতে দিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বড় ভাইয়েরাও কিশোরদের বিভিন্ন দলকে কাছে টানেন। মিছিল সমাবেশেও কিছু কিশোরকে এখন অংশ নিতে দেখা যায়।

ষোলোশহরের ২ নম্বর গেট এলাকায় তল্লাশি চালানোর সময় পাঁচলাইশ থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল হালিমকে গুলি করে পালিয়ে যায় ১০ কিশোর ও তরুণ। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ সদস্যকে গুলি করে তাদের একজন। ১০ জনকে আসামি করে পুলিশ থানায় মামলা করে। এ ঘটনায় জড়িত ছয়জন গ্রেপ্তার হয়। তাদের তিনজন ১৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে তারা বলে, ২ নম্বর গেট এলাকার যুবলীগ নেতার কাছ থেকে অস্ত্র নিয়েছিল তারা। কিশোরেরা মো. ফারুক ওরফে টোকাই ফারুক নামে যুবলীগের এক নেতার নাম বলেছে।
যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফারুকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, জবানবন্দিতে নাম আসা যুবলীগ নেতাকে ধরার চেষ্টা চলছে।

গত ১৬ জানুয়ারি ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে জামালখান মোড়ে ব্যস্ত সড়কে স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে খুন করে কয়েকজন কিশোর। ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পুলিশ তাদের শনাক্ত করে। গ্রেপ্তারের পর গত ১৯ জানুয়ারি পাঁচ কিশোর খুন করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়। তারা বলেছে, ঘটনার দিন তাদের হাতে পিস্তল থাকায় ভয়ে সামনে কেউ আসেনি। এনাম হোসেন নামের এক ছাত্রলীগ নেতা তাদের অস্ত্রটি দিয়েছিলেন। পাঁচ কিশোরের একজন নগরের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। দুজন একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। বাকি দুজন পড়ালেখায় অনিয়মিত।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোরেরা এনাম নামের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পিস্তল নেয়। এনাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত।
এক মাস পার হলেও পুলিশ এনামকে ধরতে পারেনি। তাঁকে গ্রেপ্তার ও অস্ত্রটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ওসি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম বলেন, কিশোরদের হাতে যারা অস্ত্র তুলে দেয়. তাদের কোনো ছাড় নেই। এক আওয়ামী লীগ নেতার আশ্রয়ে থেকে তারা এসব অপকর্ম করে আসছে। পুলিশও তাদের ধরছে না। তবে সেই নেতার নাম বলতে চাননি তিনি।

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, স্কুলপড়ুয়া কিশোরেরা যেভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তা পুলিশের একার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্তানেরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, খোঁজ রাখতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বাইরে আড্ডায় থাকলে অভিভাবকদের কঠোর হতে হবে।