নারীর ক্ষমতায়নে প্রতিষ্ঠায় যেতে হবে আরও বহুদূর

দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। তবে এই ক্ষমতায়ন সর্বস্তরে নিশ্চিত হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি এখনও অনেক কম। তাই নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় যেতে হবে আরও বহুদূর।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আজ রোববার আয়োজিত ‘সর্বত্র নারীর আরও উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিলে বক্তরা এ কথা বলেন।

আলোচনায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেছেন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন করতে চাইলে নারী উন্নয়নের বিকল্প নেই। নারীকে বাদ দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা কেউ ভাবলে তা হবে বোকার স্বর্গে বাস করার মতো। দেশে উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, সেটা ধরে রাখতে হলে নারীকে বাড়তি কিছু সুযোগ দিতে হবে।

বাল্যবিবাহ এবং নারী নির্যাতনকে নারী উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ দেন। একই সঙ্গে নারীদের বিষয়ে সমাজের নেতিবাচক মানসিকতা পরিবর্তনেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মেহের আফরোজ চুমকি শহুরে নারীর পাশাপাশি গ্রামীণ নারী যাতে কোনোভাবেই পিছিয়ে না থাকে সে দিকে নজর দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের দুই কোটি নারী যাতে ঘরে বসে উপার্জন করতে পারে, সে জন্য ইনকাম জেনারেটিং প্রোগ্রামের আওতায় ১৮টি ট্রেডে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা নারীদের যাতায়াত ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। এ মন্ত্রণালয় থেকে নারীদের শুধু সেলাই ফোড়াই নয়, মোবাইলে অর্থ উপার্জন, ড্রাইভিং, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে, তা অনেক দেশেই অনুপস্থিত। তবে এই ক্ষমতায়ন সর্বস্তরে হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি এখনও অনেক কম। তাই যেতে হবে আরও বহুদূর।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের নেতৃত্ব বাড়াতে হলে প্রথমত নারীদের মধ্যে যে সংকোচ কাজ করে তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে রোববার আয়োজিত ‘সর্বত্র নারীর আরও উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে রোববার আয়োজিত ‘সর্বত্র নারীর আরও উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান নারী ও পুরুষকে আলাদা চোখে না দেখার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পারিবারিকভাবে একটি স্তর পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ সম্ভব, তবে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে হলে নারীর সক্ষমতাও থাকতে হবে।

পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের অবদানের কথা উল্লেখ করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, স্থানীয় বিভিন্ন কসমেটিকসের প্রধান ক্রেতা এই নারী শ্রমিকেরা। এ খাতের অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন দিকে সরকার নজর দিলে ভবিষ্যতেও এ খাতে নারীদের অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে।

অনেক সময় নারীরা নিজেরাই ধরে নেয় কাজটি তারা পারবে না। ফলে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে যান—এমন মন্তব্য করেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কান্ট্রি হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিটপী দাশ চৌধুরী। বলেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। আর এ প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মী যাতে জেন্ডার বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ঝরে না যায় সে জন্য জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, নারী উন্নয়নে অগ্রগতির চিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে নজর বাড়াতে হবে। নিয়মিত বেতনে চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে সমতা আসেনি। বিনা বেতনে কাজ করা নারীর সংখ্যা অনেক বেশি।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহিন আরা বেগম বলেন, এখন পর্যন্ত মেয়েকে সন্তান হিসেবে ভাবার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। কর্মজীবী নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এ ছুটিকে প্রয়োজন হিসেবে না দেখে বাড়তি সুবিধা হিসেবে দেখা হয়।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের চাইল্ড প্রোটেকশন স্পেশালিস্ট শাবনাজ জাহেরীন বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে নির্বাচিত নারী মেম্বারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এ পদগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আলংকারিক পদ। তাই অংশগ্রহণের পাশাপাশি কর্মপরিবেশটাও জরুরি।
‘শিক্ষিত নারীরা সন্তান, পরিবারের কথা চিন্তা করে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে পারছেন না। এই নারীদের সহায়তায় সরকারকে নীতি প্রণয়ন করতে হবে’— বলে মন্তব্য করেছেন ইউসেপ বাংলাদেশের চিফ প্রোগ্রাম অফিসার হাবিবুর রহমান। বলেন, ইউসেপের ৫৪টি স্কুলে ৫৪ ভাগ শিক্ষার্থী মেয়ে এবং কারিগরি শিক্ষায় ৪৬ ভাগই নারী। এই নারীরা সমাজে প্রান্তিক নারী হিসেবে পরিচিত।

অভিনেত্রী মৌটুসী বিশ্বাস নারী নির্যাতন বন্ধে পরিবারে ছেলে শিশুদের দিকে নজর বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ছেলে শিশুদের ছোট বেলা থেকেই নারীদের সম্মান দেখানো শেখাতে হবে। কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি নারীর ঘরের দায়িত্ব পালনে পুরুষদের এগিয়ে আসা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন বলেন, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে বিদেশের কোনো ক্লাবে খেলছেন তিনি।

আলোকচিত্রী এবং বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারীর বেশি দায়। যন্ত্রণা যেহেতু আমার, কথাও বলতে হবে আমাকেই।’ তিনি বলেন, নারীর অবসর নেই। সন্তান পালনে নেই ডে কেয়ার সেন্টার। সিনেমা, নাটকে এই নারীর সংগ্রামকে তুলে ধরতে হবে। নারী-পুরুষে সমতা তৈরিতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।