ভুয়া চিঠিতে রানির দিঘি বেহাত

রানির দিঘি। ছবি: প্রথম আলো
রানির দিঘি। ছবি: প্রথম আলো

• নাটোরের জয়কালী দিঘির আয়তন ২৭ দশমিক ১৩৯৬ একর।
• দিঘিটি নাটোরের ঐতিহ্য।
• পৃথিবীর বহু দেশ থেকে লোকজন এখানে আসেন।

রানি ভবানীকে বলা হতো অর্ধবঙ্গেশ্বরী। নাটোরে তাঁর রাজবাড়ির দ্বিতীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী ছিল ৮১ বিঘা আয়তনের এক দিঘি। জয়কালী নামের ঐতিহ্যবাহী এই দিঘি ২০০৬ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী এক ব্যবসায়ীকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্তে ধরা পড়ে, ওই চিঠি ভুয়া ছিল। জেলা প্রশাসন গত মাসে ওই বন্দোবস্ত বাতিলের জন্য পুনরায় মন্ত্রণালয়ের তদন্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছে।

ইজারাগ্রহীতা গোলাম নবী নাটোর আধুনিক মৎস্য চাষ প্রকল্প লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দলিলে তাঁর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে নিচাবাজার, নাটোর সদর।

নাটোর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১ নম্বর খাসখতিয়ানভুক্ত জয়কালী দিঘির আয়তন ২৭ দশমিক ১৩৯৬ একর বা ৮১ বিঘার একটু বেশি। দিঘিটি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত নিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে’ মাছ চাষ করতে গোলাম নবী ২০০৫ সালের ২১ মে আবেদন করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নাটোর জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেয় (স্মারক নম্বর ৭৬)। চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী ১ মার্চ গোলাম নবীর সঙ্গে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দলিল সম্পাদিত হয়। জেলা কালেক্টরের প্রতিনিধি হিসেবে নাটোরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ইফতেখারুল ইসলাম খান দলিলে স্বাক্ষর করেন। সালামিবাবদ ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৩ টাকা পরিশোধের বিনিময়ে ৩০ বছরের জন্য দিঘিটি গোলাম নবীকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।

বিষয়টি জেনে তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বন্দোবস্ত বাতিলের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে পত্র (ডিও লেটার) দেন। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়। এই চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে গোলাম নবী ওই বছরের ৭ জুলাই আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। ২৫ জুলাই আদালত ইজারাগ্রহীতাকে মাছ চাষে বাধা দেওয়া যাবে না মর্মে আদেশ দেন।

এদিকে চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন দিঘিটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। ওই বছরের ১১ অক্টোবর মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য যুগ্ম সচিব মো. রেজাউল করিমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে রিটের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল অনুমতির আবেদন (লিভ টু আপিল) করতে বলা হয়। একই সঙ্গে সরকারি সম্পত্তি বেহাত প্রক্রিয়ায় সহায়তার ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং দলিল বাতিলের জন্য দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে বলা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দিঘিটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৩ টাকায় ইজারা দেওয়ায় সরকারের ১ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার ৫১২ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। আবার দিঘিটি ‘অকৃষি খাসজমি’ হিসেবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।

এরপর ৮ মার্চ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে নাটোর জেলা প্রশাসককে জানানো হয়, যে চিঠির ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, তা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়নি।

সর্বশেষ আপিল বিভাগের রায় হয়েছে গত নভেম্বর মাসে। নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, রায়ে বলা হয়েছে যে ইজারাগ্রহীতা নিজের পক্ষে দিঘির স্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্য ওই ভুয়া চিঠি তৈরির ব্যাপারে যদি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রভাবিত করে থাকেন আর তা প্রমাণিত হয় তাহলে এই বন্দোবস্ত বাতিল করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, তাঁরা মন্ত্রণালয়ে পুনরায় বিষয়টি তদন্তের জন্য চিঠি দিয়েছেন।

রানির দিঘি। ছবি: প্রথম আলো
রানির দিঘি। ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে গোলাম নবী মুঠোফোনে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সালামির টাকা পরিশোধ করে তিনি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। আদালত পরপর দুবার তাঁর পক্ষেই রায় দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের ভুয়া চিঠির ব্যাপারে তিনি বলেন, সেটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তাঁর বিষয় হলে তদন্তের সময় তাঁকে ডাকা হতো।

সম্প্রতি দিঘির কাছে গিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করে একজন বললেন, এক দিকে রানি ভবানী, অপর দিকে কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন—এ দুইয়ে মিলে নাটোর একটা কিংবদন্তি। এই দিঘি নাটোরের ঐতিহ্য। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে লোকজন এখানে আসেন।