গোলবনের সুন্দরী হাঁস
একুশ বছর আগে সুন্দরবন গিয়ে ভাটার সময় গোলবনের কর্দমাক্ত অচেনা এক খালের পাড়ে রহস্যময় একটি পাখির দেখা পেয়েছিলাম। এরপর বহুবার সুন্দরবন গেছি কিন্তু পাখিটির দেখা পাইনি। এ বছরের ২৫ জানুয়ারি ছেলে নাফিমসহ ফের সুন্দরবন রওনা হলাম পাখিটির সন্ধানে। বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালী পৌঁছালাম ২৬ জানুয়ারি। পরদিন সকালে বাঘের বাড়িখ্যাত কটকার পথে রওনা হলাম। ভাটা চলছে। কাজেই ক্যামেরা হাতে আমরা সাতজন টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খালের দুপাশে গোলগাছের সারি। দৃষ্টি সবার এই গোলবনের পলিময় কাদার দিকেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে হাঁসের মতো কিন্তু অদ্ভুত একটি পাখির চেহারা ভেসে উঠল। ঠোঁটটি হাঁসের মতো চ্যাপ্টা নয় বরং চোখা। পায়ের পাতা আঙুলের সঙ্গে যুক্ত নয়। বিচিত্র এক পাখি। মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎই বলে উঠলাম, হাঁসপাখি! হাঁসপাখি! পাখিটি দ্রুত গোলবনের কাদাময় পাড় থেকে পানিতে নেমে গেল। মন-প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল। খানিক পর এই খালেই আরও দুটি এবং পরদিন সকালে অন্য একটি খালে চারটি পাখির দেখা পেলাম।
এরা এ দেশের বিরল ও বিপন্ন এক পাখি সুন্দরী বা গোইলো হাঁস। সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালি-মৌয়াল-জোংরাখোটাদের কাছে ওরা এই নামেই পরিচিত। অবশ্য অনেকে এদের গোলবনের হাঁসপাখি বা বাইলা হাঁস নামেও ডাকে। তবে নাম হাঁসপাখি হলেও আদতে হংস বা Anatidae গোত্রের ধারেকাছের পাখিও নয় এটি। বরং জলমুরগি, রাঙা হালতি, ডুংকর, ডাহুক, কোড়া, কালেম ও সারস ক্রেন পাখিদের নিকটাত্মীয় এরা। পাখিটির ইংরেজি নাম Masked Finfoot বা Asian Finfoot. Helornithidae গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম heliopais personata।
সুন্দরী হাঁসের দেহের দৈর্ঘ্য ৫৬ সেন্টিমিটার। দেহের পালকের মূল রং গাঢ় বাদামি। লম্বা গলাটি হালকা বাদামি। পিঠ জলপাই-বাদামি। ডানার প্রাথমিক পালক কালচে জলপাই-বাদামি। বুক-পেট-লেজতল হালকা বাদামি। চোখের পেছন থেকে ঘাড় পর্যন্ত সাদা ডোরা রয়েছে। হলুদ ঠোঁটটি লম্বা ও ড্যাগারের মতো চোখা। পায়ের আঙুলে পর্দা থাকলেও তা হাঁসের মতো পায়ের পাতায় যুক্ত থাকে না। বরং দেখতে অনেকটা মাছের পাখনার মতো। পায়ের রং সবুজাভ-হলুদ। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় অল্পবিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের ঘাড়, গলার সম্মুখভাগ ও চিবুক কালো। চোখ গাঢ় বাদামি ও চঞ্চুর গোড়ায় শিংজাতীয় পদার্থ থাকে। অন্যদিকে, স্ত্রীর চোখ হলুদ ও চঞ্চুর গোড়ায় শিং থাকে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপালের ধূসর ও চঞ্চুর ক্রিম-হলুদ রং ছাড়া বাকি সবই দেখতে স্ত্রী পাখির মতো।
সুন্দরী হাঁস বিরল আবাসিক পাখি, বর্তমানে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত। একমাত্র সুন্দরবনেই দেখা যায়। অতি লাজুক এই পাখিটি একাকী, জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে বিচরণ করে। অল্প পানিতে সাঁতার কেটে বা কাদায় হেঁটে চিংড়ি, ছোট মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙাচি, শামুক, জলজ কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়। ভয় পেলে বা বিপদ দেখলে চঞ্চুসমেত মাথা পানিতে ভাসিয়ে ডুবে থাকে বা দ্রুত দৌড়ে পালায়।
জুলাই থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় মাটি বা পানি থেকে ১-৩ মিটার ওপরে গাছের বড় শাখায় ঘন পাতার আড়ালে কাঠিকুটি ও শিকড়-বাকড় দিয়ে স্তূপের মতো গোলাকার বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৮টি। আয়ুষ্কাল ১০ বছরের বেশি।