ওয়াসা নিয়ে গণশুনানিতে ক্ষোভ গ্রাহকদের

>
  • বিল মিটিয়েও ঠিকঠাক পানি পাওয়া যায় না
  • বকেয়া বিল মেটাতে ঘুষ চান কর্মকর্তারা
  • ভুতুড়ে বিলের উপদ্রব আছে ওয়াসায়

ওয়াসা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানির কথা শুনে রাজধানীর মিরপুরের বড়বাগ এলাকার নজরুল ইসলাম ছুটে এসেছেন। পানি সমস্যায় জর্জরিত এ ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের এলাকার কিছু অংশকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা উচিত। ১০ বছর ধরে আমরা পানির জন্য কষ্ট করছি কিন্তু পানি পাই না। এই পানির জন্য ঘুরতে ঘুরতে পায়ের জুতা কয়েক জোড়া ক্ষয় করছি কিন্তু সমাধান পাইনি। কবে সমাধান পাব, সেটাও কর্মকর্তারা আমাদের জানান না।’

বুধবার মিরপুরের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট মিলনায়তনে এ শুনানি হয়।

এ প্রসঙ্গে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওয়াসার কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বলেন, ‘বড়বাগসহ আশপাশের এলাকা অনেক জনবহুল। সেখানে পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হচ্ছে। আশা করছি, আগামী এক মাসের মধ্যে বড়বাগের পানির সমস্যা চিরদিনের জন্য শেষ হবে।

দুদক আয়োজিত গণশুনানিতে ভুক্তভোগীরা নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এঁদের একেকজনের সমস্যার ধরন একেক রকম। কেউ মাসের পর মাস বিল মিটিয়েও ঠিকঠাক পানি পান না। পাইপলাইনে যেটুকু পানি আসে, তাতেও দুর্গন্ধ। বকেয়া বিল মেটাতে গিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ঘুষের প্রস্তাব পাওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। আবার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান এবং পুনরায় তা জোড়া দেওয়ার কাজে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা দেখছেন অনেকে। এর পাশাপাশি ভুতুড়ে বিলের উপদ্রবের কথাও তুলে ধরেন কেউ কেউ।

ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৪ ও ১০-এর দুই নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গ্রাহকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। এতে বাউনিয়া বাঁধ, উত্তর ইব্রাহিমপুর, মিরপুর-১০, পীরেরবাগ, বড়বাগ, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, কালাপানি, কালশী, পশ্চিম মণিপুর এলাকার অর্ধশতাধিক গ্রাহক অংশ নেন। সুযোগ পেয়ে কর্মকর্তাদের দিকে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দেন তাঁরা। উগরে দেন ক্ষোভ। জবাব চান প্রতিটি প্রশ্নের।

শুধু প্রশ্নতেই শেষ ছিল না। সমাধানের আশ্বাসও পান। তবে সমাধানের আশ্বাসই শেষ কথা নয় বলে জানিয়েছ দুদক। গণশুনানিতে তুলে ধরা সমস্যাগুলো কতটা সমাধান হয়েছে, সে বিষয়ে ২ মে আরেকটি গণশুনানি হবে বলে জানিয়েছ দুদক।

গণশুনানিতে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন শত শত অবৈধ সংযোগ দেওয়ার। দিনের বেলায় ওয়াসার কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে লাইন কেটে দিয়ে রাতের বেলায় ওয়াসার লোকজনই অবৈধ লাইনগুলো আবার সংযোগ দিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় দালালদের সঙ্গে ওয়াসার কর্মকর্তারা আঁতাত করেই এমন জালিয়াতি করে গেলেও আমরা বৈধ গ্রাহকেরা পানি পাই না। সেবা চাইতে গেলে আমাদের পাত্তা দেয় না, খারাপ ব্যবহার করেন।’

মিরপুরের বাউনিয়াবাদ থেকে আসা সেবাগ্রহীতা মো. মোশারফ হোসেন অভিযোগ করেন, তিনি বিল পরিশোধ করার বিষয়ে একাধিকবার ওয়াসার স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়েও কোনো সমাধান পাননি। ওয়াসার কর্মকর্তারা ঘুষ চেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। ওই সময় দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার বিষয়টি ওয়াসার কর্মকর্তা কাজী ফখরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শুরুতে মোশারফ হোসেনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে কাজী ফখরুল নীরব থাকেন। পরে সমস্যাটি তিন দিনের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

উত্তর ইব্রাহিমপুরের শহিদুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দিনের পর দিন যায় কিন্তু আমরা ঠিকমতো ওয়াসার পানি পাওয়া যায় না। টাকা দিয়ে পানি কিনে চলতে হয়। পানির জন্য বারবার ওয়াসা কার্যালয়ে গেলেও কোনো লাভ হয় না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কথা শুনবেন দূরের কথা, অফিসে গেলে পাত্তাই দেন না কর্মকর্তারা। কিন্তু কেউ টাকা দিলেই সব সমস্যা সমাধান হয়। টাকা দিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাড়িতে করে পানিও দিয়ে আসেন ওয়াসার লোকেরা।’ এ প্রসঙ্গে ইব্রাহিমপুর এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মজিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি তিন মাসের মধ্যে ওই সব এলাকার পানির সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দেন।

মিরপুর বড়বাগ এলাকার তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা মাসের পর মাস পানি পাই না। কিন্তু এক মাইল দূরে মানুষ পাম্পের লোকদের সঙ্গে আঁতাত করে পানির লাইন নিয়েছে। কিন্তু পাম্পের পাশেই পানি পাই না।’

দিনের বেশির ভাগ সময় পানি না থাকার এমন অভিযোগের বেশির ভাগ আসে বড়বাগ এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে। এই এলাকার পপুলার হাউজিংয়ের বাসিন্দা মারুফ বিল্লাহ বলেন, গত দেড় মাস ধরে এই সমস্যা চলছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এক গাড়ি পানি চাইলে তা আসে এক দিন পর।

জবাবে ওয়াসা কর্মকর্তারা বলেন, বড়বাগ এলাকার বেসরকারি হাউজিংগুলোতে পাম্প বসানোর কোনো জায়গা রাখা হয়নি। আর পুরোনো ছিদ্রযুক্ত পাইপের কারণেই সরবরাহ করা পানি ময়লা হয়ে পড়ে। অবশ্য আগামী তিন মাসের মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন তাঁরা।

পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন অভিযোগের আঙুল ওঠান ওয়াসার মিটার রিডারদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম মণিপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা অবৈধ সংযোগ বিক্রির সঙ্গে খোদ ওয়াসার কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন।

গণশুনানির শুরুতে ওয়াসার কিছু কর্মকর্তা সাজানো কয়েকজন ভুক্তভোগী এনে কর্মকর্তাদের শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ওই সব লোক কোনো অভিযোগ না করে ওয়াসার কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে বক্তব্য দেন। এ বিষয়ে একজন গণমাধ্যমকর্মী এ বিষয়ে দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন দুদকের কর্মকর্তারা। পরে প্রকৃত ভুক্তভোগীরা সুযোগ পেয়ে সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি ক্ষোভ ঝাড়েন। সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয় দুদকের পক্ষ থেকে।

গণশুনানির শেষ পর্যায়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান পানির সমস্যা নিরসনে ওয়াসার নানা কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন। গ্রাহকের ভোগান্তি ও হয়রানি কমাতে গোটা ওয়াসার কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানান। এ ছাড়া গুচ্ছ গুচ্ছভাবে পাইপলাইন বদলে, এলাকাভিত্তিক পাম্প নির্দিষ্ট করে দিয়ে সব কটি ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়ার (ডিএমএ) কাজ শেষ হলে পানির সরবরাহের ক্ষেত্রে আর কোনো সমস্যা থাকবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আশা করছি ভবিষ্যতে মিরপুর নয়, সারা ঢাকা শহরের মানুষ ভোগান্তিমুক্ত ঢাকা ওয়াসা পাবে।’

দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদ ওয়াসা কর্মকর্তাদের জনগণের আস্থা অর্জনের তাগিদ দিয়ে বলেন, এখানে আচরণগত বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘ওয়াসা ইতিমধ্যে বেশ কিছুর উন্নতি করেছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সেবা পাচ্ছে। কিন্তু ওয়াসার ওপর মানুষের পুরোপুরি আস্থা আসেনি।’